আওয়ামী লীগের ধারাভাষ্য, গত ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, মেগা প্রজেক্ট, নান্দনিক বিভিন্ন স্থাপনা দেশের উন্নয়নখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। অর্থনীতির চাকা সমুন্নত হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। উন্নয়নের নানা প্যারামিটারে আওয়ামী লীগ তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।
এক শ্রেণির গোষ্ঠীর কাছে আওয়ামী লীগের অপরাধ হলো, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিচার। আওয়ামী লীগের আরো দোষ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ রেখে একচেটিয়া শাসন চালু করা।
পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগের আরো দোষ হলো, সন্তোষজনক ভোট ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা, জনগণের ভোটাধিকার হরণ, চাওয়া-পাওয়াকে অবদমন রাখা, বিরোধী মতকে আইনি-মারপ্যাঁচে পিষ্ট রাখা, মানবাধিকার সুসংহত করতে না পারা, ব্যাপক দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করা।
সর্বোপরি, আওয়ামী লীগের বড় দোষ হলো একগুঁয়েমি শাসন, এক ব্যক্তির ইচ্ছামাফিক শাসক ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, দম্ভের প্রকাশ, অতিরিক্ত বল প্রয়োগে কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহার করে অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে।
আওয়ামী লীগের জন্য বড় ট্র্যাজেডি হলো— দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করা, দলের মধ্যে বিভেদকে গুরুত্ব না দেয়া, হাইব্রিড আওয়ামী লীগারকে রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। সারা দেশে হাজার লাখো লাখো নেতাকর্মী, অর্ধশত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, তিন শতাধিক সংসদ সদস্য, নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা; বিপদের দিনে আওয়ামী লীগের পাশে কেউ নেই। ফলস্বরূপ নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থায় দেশ ছাড়তে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে।
(২) বিএনপির শাসনামলে দেশের পরিস্থিতি কী রকম ছিল সেই তুলনাও আওয়ামী লীগের শাসনের সঙ্গে করা যায়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র, জঙ্গিবাদের বিস্তার এগুলো বিএনপির শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। এরপর দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিণতিও জানা।
পুলিশের চাপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানি, একের পর এক মামলার ভারে গত ১৫ বছর বিএনপি ছিল কার্যত দেউলিয়া। ধুঁকে ধুঁকে রাজনীতি চালিয়ে গেলেও বড় ধরনের পট পরিবর্তনে বিএনপি কুলিয়ে উঠতে পারেনি আওয়ামী লীগের একচেটিয়া শাসনের সঙ্গে।
জনরোষ, জনস্রোত, ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বড় ‘সুবিধাভোগী’ বিএনপি। আইনি লড়াইয়ে ও আইনি মারপ্যাঁচে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে এতদিন মুক্ত করতে না পারলেও এ অভ্যুত্থানের বড় ফসল এরই মধ্যে বিএনপি তাদের ঘরে তুলতে পেরেছে। তা হলো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে খালেদা জিয়ার মুক্তি লাভ। বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে রাজনৈতিক মামলার হার ধীরে ধীরে কমে আসবে। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা তারেক রহমানের দেশে ফেরার সবুজ সংকেতও হয়তো আদায় করতে পারবে বিএনপি।
সব মিলিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ পাবে, ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।
বিএনপি এরই মধ্যে বিজয়ের স্বাদ অনুভব করার চেষ্টা করছে। তাদের মনে এই আত্মবিশ্বাস জোরালো হচ্ছে যে, তারা আগামীতে ক্ষমতায় আসবেন কিংবা এখনই ক্ষমতায় আসার দ্বার তাদের উন্মুক্ত হচ্ছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও ‘শেখ হাসিনা’র এই পতন থেকে তাদের শিক্ষা নেয়ার সুযোগ আছে। আশা করি, বিএনপি সেই শিক্ষাটি নিয়ে রাজনীতির সামনের পথগুলো পাড়ি দেবে।
(৩) এ আন্দোলনের আরেকটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। দল-মত নির্বিশেষে রাজনীতি করার সুযোগ পেতে পারে জামায়াত-হেফাজতে ইসলাম-ইসলামী আন্দোলন। এরই মধ্যে একাধিক বৈঠকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিতে পেরেছে। আইনি লড়াইয়ে জামায়াত তার দলীয় নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবে। নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ চাইবে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যদি ওড়ে তাদের গাড়িতে তা অবাক হওয়ার মতো কিছু ঘটবে না। হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর আস্ফাালন বাড়বে রাজনৈতিক মদদে। কারণ বিএনপি এখন জামায়াতকে ছাড়েনি, জামায়াতও বিএনপিকে ছাড়েনি।
(৪) রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ এখন বিপন্ন অবস্থায়, ছত্রভঙ্গ অবস্থায়! লাখো লাখো নেতাকর্মীর প্রতি কোনো রকম বার্তা না দিয়েই দেশ ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ফলে আওয়ামী লীগের সামনে এখন কোনো ভরসা নেই। একচেটিয়া শাসনের মাধ্যমে যে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই দেউলিয়ার ফাঁদেই এখন আওয়ামী লীগ। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে তা অজানা।
আওয়ামী লীগের এমপিরা গা ঢাকা দিয়েছেন, মন্ত্রীরাও আত্মগোপনে। কেউ কেউ দেশত্যাগ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে এসেছেন। বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দেশে আরেকটা নির্বাচনের আয়োজনের কাজটি হবে প্রধান এবং একমাত্র কাজ। কিন্তু সেখানে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ হবে কি না হবে না কিংবা হলেও কী মাত্রায় তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। আগামী নির্বাচনে দেশের বড় এই রাজনৈতিক দলকে আবার যদি ক্ষমতায় আনা না যায় তাহলে সেই নির্বাচনও অসন্তুষ্টির কারণ হবে, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু হবে সেটিও ভাবনার বিষয়।
আওয়ামী লীগ প্রধান বৃহত্তর স্বার্থেই, নিজের গোছানো দলের স্বার্থেই চাইলে আবার দেশে ফিরতে পারেন। আইনি প্রক্রিয়াগুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে তিনি হাল ধরতে পারেন আওয়ামী লীগের। কারণ বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাল তো তার কাছেই, দলের চাবিকাঠি তো তার কাছেই।
আমরা যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যে নতুন অভিযাত্রার কথা বলছি সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া গণতান্ত্রিক যাত্রাটি কতখানি পূর্ণতা পাবে- সেটিও এ মুহূর্তের বড় প্রশ্ন।
(৫) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক আওয়ামী লীগারকে চিনতাম। বিপ্লবীকে চিনতাম। তাদের মুখে ছিল ‘জয়বাংলা স্লোগান’। এরা এখন নেই। এরা সুবিধাবাদী। এদের অনেকের ফেসবুক আইডি নিষ্ক্রিয়। এরা রাজনৈতিক হাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদল করে ফেলেছেন নিজেদের। মুখে কুলুপ এঁটেছেন, চুপ করে আছেন।
কেউ স্ট্যাটাসের ‘জয়বাংলা’ স্লোগান মুছে দিয়ে রাতারাতি স্বামী-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের ছবি পোস্ট করেছেন। মুখে মুখে ফেনা তোলা ‘শহীদ’ পরিবারের কথিত সন্তানও তীব্র গরমে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন!
হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চেতনাধারী এ আওয়ামী লীগাররা আগের স্ট্যাটাসগুলো মুছে চুপচাপ ঘরে বসে আছেন। এখন ঘরে বসে ঝালমুড়ি-বাদাম চিবুচ্ছেন আর টেলিভিশনের খবর দেখছেন।
অথচ এ চেতনাধারীরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নানা সুবিধা পেয়েছেন, আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়েছেন। তারা এখন কোথায়?
আশা করা যায়, আওয়ামী লীগ কোনো একসময় বন্ধুর বেশে থাকা সুবিধাবাদীদের চিনে রাখবে। এ শিক্ষাটিও আওয়ামী লীগের জন্য বড় দরকার।
(৬) আগস্ট মানেই ষড়যন্ত্র, আগস্ট মানেই আওয়ামী লীগের কাছে শোক, বেদনা। শেখ হাসিনার এ পরাজয় দলটির জন্য নিঃসন্দেহে শোকের পাল্লা আরো ভারি করল! ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগকে বিনাশ করা যায়নি, জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আওয়ামী লীগকে বিনাশ করা যায়নি, আওয়ামী লীগকে বিনাশ করতে পারেনি স্বৈরাচার এরশাদ, আওয়ামী লীগকে ২০০৪ সালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার মাধ্যমেও বিনাশ করা যায়নি।
২০২৪ এর এ ঘটনা আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের শিক্ষার সুযোগ হতে পারে। আওয়ামী লীগ এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সত্যিকার অর্থে দেশ জাতির একটি দল হয়ে উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগ এককেন্দ্রিক, এক ব্যক্তির শাসনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে হতে পারে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক একটি দল। এটুকু তো জাতির এ ক্রান্তিকালে আশা করা যায়।
দলের কোনো কোনো নেতাকর্মীর আশাবাদ— আওয়ামী লীগ আবার ফিরবে, ঘুরবে, আওয়ামী লীগ আবার আসবে। তাদের বিশ্বাস আওয়ামী লীগ মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আওয়ামী লীগ মানেই প্রগতি, আওয়ামী লীগ মানেই দেশের উন্নয়ন। তাদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে এ কারণে যে ইতিহাস বলে আওয়ামী লীগকে বিনাশ করা যায় না, আওয়ামী লীগ এক ফিনিক্স পাখির নাম।
আওয়ামী লীগ এখনো বিশ্বাস করে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের তর্জনি আবার ফিরে আসবে। আবার ফিরে আসবে রক্তে প্রাণের সঞ্চার তোলা সেই ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ