ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে সতর্ক থাকতে হবে

প্রকাশনার সময়: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪৯

রাজনৈতিক জীবনের টানা ১৬ বছর রাষ্ট্র শাসন করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলের উচ্চ বিলাসিতা জীবন ধারণ মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা দেশের মধ্যে এমন একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিলেন যে তার কথার বাহিরে কোনো কাজই দেশে হতো না। তার জীবনে এমন পরিস্থিতির শিকার হবে সেটা তিনি কখনো ভাবেননি। তার সরকারে থাকা মন্ত্রী এমপিরা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের ওপর যেমনে খুশি শাসনব্যবস্থা কায়ম করেছেন। যেটা দেশের মানুষ দীর্ঘদিন কষ্ট করে হলেও মেনে নিয়েছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষ এমন এক পর্যায়ে এসে গেল তারা আর কোনোভাবেই নিজেদেরকে সামলাতে পারল না, তখন দেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন। যে ঘটনা বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে লিখিত হয়ে থাকবে।

এটা একটা জাতির জন্য কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি তার ভুলের জন্য নিজেও মরলেন দেশ ও দেশের মানুষকে মেরে গেলেন- যেটা কোনোদিন শেখ হাসিনার কাছে এদেশের মানুষ আশা করেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফল হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে গেলে দেশের মধ্যে একটা আনন্দ উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আনন্দ উল্লাস ও আবেগ দিয়ে দেশ চলবে না দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হলে দেশের সব জনগণের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে নতুন করে গড়ে তোলার কাজ করতে হবে। গণতন্ত্রহীনতা, বাকস্বাধীনতা হরণ, অন্যায়, অবিচার কবলিত দেশকে সংস্কার করে আদর্শ ও উন্নত করার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ দ্রুত শুরু করা এখন সময়ের দাবি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পরপর কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ মারফত পাওয়া গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে ও আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এ দেশ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আমাদের, কেউ যাতে কোনো ধরনের লুটপাট, সাম্প্রদায়িক হামলা ও কোনো ধরনের উসকানিতে প্ররোচিত না হন।

মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে সতর্ক থাকতে হবে এবং দেশের সম্পদ রক্ষা করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় মাঠে থাকবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ছাত্র-জনতার এ গণঅভ্যুত্থান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের ছিল না। যদিও বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকার একে নানাভাবে রাজনৈতিক রং ও জঙ্গিদের বলে আখ্যায়িত করার অপচেষ্টা করেছে। তবে সরকারের এ পুরোনো ‘জঙ্গি কার্ড’ কোনো কাজে আসেনি। বরং যেসব স্থাপনা ধ্বংস ও সংখ্যালঘুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, তা পুরোপুরিভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা করেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। এর অসংখ্য নজির পতিত সরকারের শাসনকালে রয়েছে এবং তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ পর্যবেক্ষকরা করেছেন।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর দেশকে এখন দ্রুত স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। যত দেরি হবে, তত সমস্যা ও সংকট প্রকট হয়ে উঠবে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মী ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে না, এর নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন স্থাপনা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে তাদের ধ্বংসাত্মক কাজ করার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের প্রতিশোধের স্পৃহা ভয়াবহ আকারে প্রকাশিত হতে পারে। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টা আগে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আমি আমার পরিবার নিয়ে চিন্তা করি না।

সরকার চলে গেলে আপনাদের কি হবে, তা দেখবেন। তার এ ধরনের ভিডিও বার্তা থেকে দেশ অস্থিতিশীল করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলোও পতিত হাসিনা সরকারের জন্য অনেকটা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পরপর ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তার অনলাইনের বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে তাৎক্ষণিকভাবে লিখেছে, শেখ হাসিনা ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু ছিলেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পর তাঁর দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে হারাল নয়াদিল্লি। তাই শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশত্যাগ ভারতের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গতকাল কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সেনাবাহিনীকে শেখ হাসিনাকে সরানোর অনুঘটক হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর ভারতের সব দলের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার দিকে আমরা নজর রাখছি। সঠিক সময় এলে ভারত সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেবে। ভারতের অন্যান্য পত্রপত্রিকাও বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করছে।

এসব সংবাদ বিশ্লেষণে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। এটা অনুমিতই ছিল। কারণ, ভারত শেখ হাসিনাকে দিয়ে তার যত চাওয়া-পাওয়া ছিল, তার সবই আদায় করে নিয়েছে। শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি, তা সে সারাজীবন মনে রাখবে। এমন নিঃস্বার্থ বন্ধু হারানো ভারতের জন্য বেদনারই বটে! তবে এর প্রতিশোধ ভারত নেবে না, এমন গ্যারান্টি দেয়া যায় না। প্রতিশোধ স্বরূপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অতীতের মতো নানা ধরনের অঘটন ঘটিয়ে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করে তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির ধ্বংস করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে অনিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে তারুণ্যের জোয়ারে উদ্ভাসিত ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান, তা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা করতে পারে। জনমনে এ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিতে পারে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জঙ্গি আন্দোলন, ভাঙচুর ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো। ষড়যন্ত্রকারীদের এসব শঙ্কামূলক অপকর্ম প্রতিহতে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানকে কোনোভাবেই ম্লান হতে দেয়া যাবে না।

বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এদেশের মানুষ কখনোই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি, এখনো দিচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থানের পরপর কোনো কোনো জায়গায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দেয়ার ঘটনা থেকেই আবারো তা প্রমাণিত হয়েছে। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কেও বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। এদেশের নাগরিক হিসেবে কোনো ধরনের ভয়ভীতিতে যেন না পড়ে তাদেরকে যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তারা যাতে দেশি-বিদেশি কোনো ধরনের উসকানি বা চক্রান্তে পা না দেয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান, তাতে তারাও শামিল ছিল। দেশের মানুষকে এ কথা বুঝতে ও বিশ্বাস করতে হবে, ভারত বিগত প্রায় ১৬ বছরে যে আধিপত্যবাদ কায়েম করেছিল, তার অবসান হয়েছে।

ভারতকে আর আধিপত্য বিস্তার করতে দেয়া হবে না এবং সে আর পারবেও না। মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান যেভাবে ভারতের আধিপত্যবাদকে ছুঁড়ে ফেলেছে, আমাদের জনগণও একই কাজ করেছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, ভারসাম্যমূলক এ পররাষ্ট্রনীতি নিয়েই আমরা চলব। নতুন যে সরকার দেশ পরিচালনা করবে, তার ওপর অনেক গুরু দায়িত্ব। পতিত শেখ হাসিনা সরকার দেশের অর্থনীতিকে যে খাদের কিনারে রেখে গেছে, গণতন্ত্রকে পদদলিত করে শাসন কায়েম করেছে, মত ও বাকস্বাধীনতা হরণ, সুশাসন ও ন্যায়বিচারহীনতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অতল গহ্বরে রেখে গেছে, তা থেকে দেশকে দ্রুত তুলে এনে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হবে।

অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গঠনমূলক সমালোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষকে স্থিতিশীল রাখতে সবার ঐকমত্যে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে।

সবার হানাহানি হিংসা বিদ্বেষ ভুলে দেশের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে হবে। একদলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আরেক দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে মনোভাব পরিষ্কার করে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বিগত শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের এমন কোনো খাত নাই যেখানে দুর্নীতির ছোঁয়া লাগেনি তা থেকে বর্তমানে ঐকমত্যের সরকারকে বেরিয়ে এসে দেশের উন্নয়নে দল মত নির্বিশেষে সব নাগরিকের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ