ঢাকা, শনিবার, ৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ পৌষ ১৪৩১, ৩ রজব ১৪৪৬

এমন নৃশংসতা যেন আর না ঘটে

প্রকাশনার সময়: ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৯:২৩

‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনকে কৌশলে নাশকতার কাজে লাগিয়ে দেশব্যাপী একশ্রেণির দুর্বৃত্ত জনগোষ্ঠী যেভাবে ঢাকাসহ দেশজুড়ে ১৭ থেকে ২১ জুলাই সহিংস তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য রোমহর্ষক। আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও প্রাণহানিতে দেশের মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। যদিও প্রতিদিনই কারফিউ শিথিল করা হচ্ছে, মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করছে এবং অফিস-আদালত, ব্যাংক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, দ্রুতই সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং কারফিউ উঠে যাবে।

দুর্বৃত্তরা মেট্রোরেল, বিটিভি ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সেতু ভবন, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কার্যালয়, বিভিন্ন স্থানের টোলপ্লাজা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস, মহাখালীর ডাটা সেন্টার, মহাখালী করোনা হাসপাতাল, পুষ্টি ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ অফিস, বিআরটিএ ভবনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে। এ ছাড়া বহু ব্যাংক, দোকানপাট, অফিস, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়েছে। দুর্বৃত্তরা নরসিংদীতে কারাগারে হামলা করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও সব কয়েদিকে বের করে দিয়েছে। আর রাষ্ট্র যেমন নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়, তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব দেশের বা রাষ্ট্রের সম্পদের সুরক্ষা করা। কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করা যাবে না। দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টকারীদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অনিষ্ট বা ক্ষতি করলে পেতে হবে কঠিন শাস্তি। দেশের অন্যান্য সম্পদের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের ঈমানি দায়িত্ব। যেহেতু এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তাই এটা দেশের আপামর জনগণের হক। এ সম্পদ দেশের মানুষের কাছে আমানত। কোনোভাবেই তা নষ্ট ও অপচয় করার সুযোগ নেই। যে বা যারা এটা নষ্ট ও অপচয় করবে, এর সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকবে তারা প্রত্যেকেই পাপের ভাগিদার হবে। পবিত্র কোরআনে বারবার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে আমানত রক্ষার জন্য। সরকারি সম্পদ জনগণ ও দায়িত্বশীলদের কাছে আমানত। আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দুষ্কৃতকারী গোষ্ঠী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ব্যাপক হারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বিনষ্ট করে দেয় মূল্যবান সম্পদ।

কোটা সংস্কারের বিষয়টি আজকের নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল। দেশের সরকারি চাকরিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কোটায় ৮০ শতাংশ, মেধায় ২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে সংস্কার করে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত কোটায় ৬০ শতাংশ, মেধায় ৪০ শতাংশ। ১৯৮৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোটায় ৪৪ শতাংশ, মেধায় ৫৬ শতাংশ। তবে এ সময়ে এসে দেখা যায় কোটাকে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, জেলা কোটা ১০, নারী কোটা ১০, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা ৫ ও প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ হারে বণ্টন করা হয়। ২০১৮ সালে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকার আংশিক সংস্কার এনে পরিপত্র জারি করে যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রথা তুলে নেন। এরপর সরকারের জারি করা পরিপত্রের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন কোটা বঞ্চিতরা। সেই রিটের শুনানি শেষে চলতি বছর ২০২৪ সালের ৫ জুন এক রায়ে ২০১৮ সালে দেয়া রায়কে আদালত অবৈধ ঘোষণা করার ফলে পূর্বের মতো ৫৬ শতাংশ কোটা বলবৎ হয়ে যায়। এ রায়ের পর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়। এরপর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দেন।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রতিটি সরকারের আমলে কোটা প্রথা ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫৪ বছর। এ ৫৪ বছর কমবেশি দেশের কিছু মানুষ কোটা সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু বর্তমান এমন একটি সময় যেখানে শিক্ষার্থীদের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় সেখানে এ ব্যবস্থা কতটুকু যৌক্তিক? যা হোক, দেশব্যাপী বহু অঘটনের পর সমগ্র জাতির দৃষ্টি ছিল হাইকোর্টের রায়ের দিকে। অবশেষে ২১ জুলাই (২০২৪) উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে আগের দেয়া রায় বাতিল করে নতুন রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মেধা কোটায় ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫ শতাংশ, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য ১ শতাংশ কোটা বণ্টনের মাধ্যমে রায় ঘোষণা করলে ছাত্ররা রায়কে স্বাগত জানান এবং রায় ঘোষণার দুই দিনের মাথায় ২৩ জুলাই সরকার এ রায়ের ওপর প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারের এটিও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কোটার বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তাই কোনো সরকারই এটি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাননি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার পরিজন নিয়ে এ দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন। ইচ্ছে করলে তার বংশধররা কোনোরকম দায়িত্ব না নিয়ে দেশে বা বিদেশে দিব্যি আয়েশে জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতার মতো মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে বিদেশের আরামের স্থান ফেলে বাঙালি জাতির অধিকারের জন্য দেশে ফিরে এসে আন্দোলন সংগ্রাম, কারাবরণ করে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন আর সেই ভোটারদের দেয়া ভোটেই তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি আজ এতটুকু এসেছেন শুধুমাত্র পিতার কারণে নয়, এর জন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আজকে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধর আছেন তারা প্রধানমন্ত্রীর আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। দেখবেন আত্মমর্যাদা আত্মসন্তুষ্টি নিয়ে সুন্দর জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। তারপরও বলব মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি জাতির গৌরবের অংশীদার। তাদের সম্মান জানানো নৈতিক দায়িত্ব। সে যেই হোক, কোটা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে দেশে তাণ্ডব চালানোকে কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। দুষ্কৃতকারীরা দেশের যেসব মূল্যবান সম্পদগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে তা সত্যিই অমানবিক। এরা মানুষ নয়, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ করেছে। এদের শাস্তি চায় দেশের মানুষ।

রাষ্ট্রীয় সম্পদে যেভাবে হামলা করা হয়েছে তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য না। যেসব সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে, তা তো জনগণের সম্পদ। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের করের টাকায় এসব সম্পদ করা হয়েছে। যারা এ সম্পদ ধ্বংস করেছেন, তাদেরও অবদান রয়েছে এ সম্পদের পেছনে। সুতরাং এ সম্পদ নষ্ট করার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে দেশের সব মানুষের ক্ষতি হয়েছে। আর একদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে অনেকগুলো প্রাণ চলে গেছে। যে আপনজন হারিয়েছে, সেই বুঝে আপনজন হারানোর ব্যথা। এ সহিংসতার ফলে কারো উপকার হয়নি বরং সবার ক্ষতি হয়েছে। তাই সবার উচিত সহিংসতা পরিহার করে শান্তির পথে চলা। আমার মতো সাধারণ মানুষ কোনো সহিংসতা চায় না। আমরা পরিবার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। অকালে কোনো মায়ের বুক খালি হোক আমরা সেটা চাই না।

এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ধ্বংস হওয়া স্থাপনাগুলোকে কার্যক্ষম করা। এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। আর ১০টা তদন্ত প্রতিবেদনের মতো যেন এটাও হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

ইতোমধ্যে ব্রডব্যান্ড সুবিধা সীমিত আকারে চালু হয়েছে। গতকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও চালু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কনটেন্টগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। সেখান থেকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের শনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। নির্দোষ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন সেটাও সরকারকে দেখতে হবে। মানুষের দাবি-দাওয়া থাকবে, সমস্যা থাকবে সেসবের সমাধানেরও পথ আছে। কিন্তু এমন নৃশংসতা যেন আর কখনো না ঘটে, শান্তিপ্রিয় মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা করে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ