দীর্ঘ ১৮ মাস পর খুলেছে স্কুল-কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে খোলার প্রস্তুতি। হলগুলোতে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার খুলে দেয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা শুধু ক্লাসে ফেরা। এমন অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩১ শিক্ষার্থী ও ১১ জন শিক্ষক। এছাড়া করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন এক শিক্ষার্থী।
দেশে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীদের আক্রান্তের তথ্য কিছুটা ভাবিয়ে তুলছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। এদিকে, এমন পরিস্থিতিতে করোনা উপসর্গ থাকলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে না পাঠানোর অনুরোধ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।
রাজধানীর একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন। এরই মধ্যে দেশের বেশ কয়েক শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। ফলে স্কুল খুললেও অনেক সময়ই তাদের বাবা-মা স্কুলে যেতে মানা করছেন। অভিভাবকরা বলছেন, আগে জীবন পরে পড়াশোনা!
অভিভাবকরা আরো বলছেন, সবকিছু খুলে দেয়া আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া এক জিনিস নয়। করোনা মহামারির একটি অঘটনে সাজানো গোছানো একটি পরিবারকে মুহূর্তে তছনছ করে দিতে পারে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে গড়ে ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে সবসময় সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মানানো আরো কষ্টকর। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনাভীতি নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ সংক্রমিত হলে সহপাঠী, প্রতিবেশী, এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তারা বলেন, করোনাকালে ঘরের বাইরে যাওয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সবাইকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ এখন নি¤œমুখী। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার চিন্তাভাবনাও চলছে। তবে জোন বা উপজেলাভিত্তিক সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সামনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এখনো আশঙ্কা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সমস্যাটি প্রকট হবে না বলে আশা করছেন তারা। তাই আতঙ্কিত না হয়ে ববং আরো বেশি সতকৃ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, শিক্ষার্থীদের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকাকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে যে এলাকার স্কুলগুলোতে আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে, সে এলাকাগুলো নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে।
জানা যায়, রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানিকগঞ্জ এসকে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী সুবর্ণা ইসলাম রোদেলা। করোনা উপসর্গ নিয়ে গত বুধবার বিকেলে মানিকগঞ্জ থেকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় রোদেলা। এর আগে ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী করোনা পজিটিভ হওয়ায় ওই শ্রেণির পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে ৫৮ জন সহপাঠীকে করোনা পরীক্ষা করানো হয়েছে। তবে কারো দেহে করোনা শনাক্ত না হওয়ায় এবং আক্রান্ত শিক্ষার্থী সুস্থ হওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে ওই শ্রেণির পাঠদান চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ শিক্ষার্থী। এদরে মধ্যে পাঁচজন সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউপির বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পঞ্চম শ্রেণির তিনজন ও চতুর্থ শ্রেণির দুইজন শিক্ষার্থী। এই দুই শ্রেণির ক্লাস সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জেলার হাজিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচজন ও সোনালী শৈশব বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর করোনা ধরা পড়ে। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে দুই সপ্তাহের জন্য এসব স্কুলে পাঠদান বন্ধ করা হয়।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার হাসিমপুরের ড. মনসুর উদ্দীন মহিলা কলেজের তিন শিক্ষার্থী আক্রান্ত। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সূত্রমতে, গত ২০ সেপ্টেম্বর মহিলা কলেজের ৫০ শিক্ষার্থীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বুধবার তিনজনের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এ বিষয়ে ওই কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুল ইসলাম জানান, করোনা শনাক্ত শিক্ষার্থীরা বর্তমানে হোম আইসোলেশন আছেন।
গোপালগঞ্জের দুই স্কুলে দুই শিক্ষার্থীর আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১০২নং বীণাপাণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোনালিসা ইসলামের শরীরে ধরা পড়েছে করোনা। ২১ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট পজিটিভ আসে এই শিক্ষার্থীর। এখন বন্ধ রয়েছে পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান। পরিবারের দাবিÑ স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয় মোনালিসা। গোপালগঞ্জেরই কোটালিপাড়ায় তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়। উপজেলার ৪ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর নাম তিনা খানম। ১৬ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা করালে তিনার করোনা ধরা পড়ে।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তবে সবার শারীরিক অবস্থা ভালো রয়েছে বলে জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। করোনা আক্রান্ত ১০ শিক্ষার্থীই হচ্ছে মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার্থী। গত ১৩ সেপ্টেম্বর মেডিকেল কলেজ খুলে দেয়ার পর তারা ক্যাম্পাসে ফেরেন। তারা শামসুদ্দিন ছাত্রাবাসের আবাসিক শিক্ষার্থী। এরপর একেক করে তাদের উপসর্গ দেখা দিলে করোনা পরীক্ষা করা হয়। রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর তাদের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্টুডেন্ট কেবিনে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, করোনা আক্রান্ত শিক্ষার্থীর বাড়িতে থাকাকালেই টিকা নিয়েছিলেন। ক্যাম্পাসে ফেরে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। সবাই সুস্থ রয়েছে।
এদিকে দুই ডোজ টিকা নেয়ার পরও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চিড়াভেজা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশান্ত কুমার রায়। এছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন একই স্কুলের আরো দুই শিক্ষক রমিজুল ইসলাম ও আব্দুল জলিল। ২১ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা করান এবং পরদিন করোনা পজিটিভ আসে তাদের। এছাড়া, আক্রান্ত হয়েছেন বাগেরহাট জেলার মোংলা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তার স্ত্রী। বগুড়া জিলা স্কুলের দশম শ্রেণি ও এসএসসি পরীক্ষার্থী দুই শিক্ষার্থী এবং রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলের এক শিক্ষার্থীও করোনা আক্রান্ত হয়েছে। তারা বাসায় আইসোলেশনে রয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, করোনা প্রতিরোধ কমিটি আছে। এগুলোকে কার্যকর করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, ইউএনও, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে পরামর্শ করতে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের বলা হয়েছে।
করোনার উপসর্গ থাকলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে না পাঠাতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমাদের সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীর বিন্দু পরিমাণ উপসর্গও যদি থাকে বা তার বাড়িতে কারো উপসর্গ থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীকে স্কুলে পাঠাবেন না।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে চাপ দেয়া যাবে না। দেখতে হবে, সে কেন উপস্থিত হলো না। কিন্তু কোনোভাবেই জোর করা যাবে না। কারণ কোনো শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণ না করতে পারলেও তার জন্য অনলাইন ও টিভিতে এখনো ক্লাস চালু আছে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ের গড় সংক্রমণকে মাথায় রেখে স্কুলগুলো খোলা হয়েছে। সে জায়গা থেকে বলতে হবে, ঝুঁকি নেই। তবে সংক্রমণের মূল্যায়ন করতে হবে উপজেলা বা ওয়ার্ডভিত্তিক। উপজেলার সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এখন বেশি সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে কমিউনিটি সংক্রমণ রয়ে গেছে। না হলে বাচ্চারা আক্রান্ত হতো না। তাই আমাদের পরিকল্পনার ধরনটি পাল্টানোর প্রয়োজন আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, শিক্ষকদের শতভাগ টিকার আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরি। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সহযোগিতা করতে হবে। অনেক অভিভাবকই স্কুলের সামনে ভিড় করেন, তারা যদি সঠিকভাবে মাস্ক পরেন, তাহলে তা সবার জন্যই ভালো হয়।
তিনি বলেন, মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফেরার সময়ে শিক্ষার্থীরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে বলে ধারণা করছি। আমরা সরকারকে বলেছি, শিশুদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফাইজারের টিকা দিতে হবে। সরকারও আমাদের পরামর্শের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ