কীএক বিস্ময়কর বিপর্যয় নেমেছে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে। স্বাধীনতার পর এতটা ভাবমূর্তি সংকটে আর পড়েছে কি সংগঠনটি?
অথচ বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে এ সংগঠনের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় বলতেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস’। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ সহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও যুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
নির্দ্বিধায় ধরে নেয়া যায় বাংলাদেশ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ একটা রাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রলীগ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে তাদের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত একদম ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে তাদের। অথচ তাদের থাকার দরকার ছিল সাধারণ মানুষের কাতারে। অতীতে যেমনটা তারা গণমানুষের দাবির প্রতি একাত্মতা দেখিয়ে সবার মন কেড়েছে।
কোটা আন্দোলনকারীরা কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ব্যক্ত করেনি। সরকারের বিরুদ্ধে কোনো স্লোগান দেয়নি। কোটা সংস্কারের একটাই মাত্র সাধারণ দাবি। সরকারের তরফ থেকে যদি বলে দেয়া হতো, বাবারা তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও, বিষয়টি নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করব। তা না করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে দিলেন, কোটা আন্দোলনকারীদের নিবৃত করবে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। মওকা পেয়ে অমনি ছাত্রলীগ হামলে পড়ল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। অভিযোগ উঠেছে নিপীড়ন করা হয়েছে নারীদেরও। একটা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের এমন আচরণ মানায়? তাদের তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর কথা। ঘৃণা ও জিঘাংসা উস্কে দেয়ার ফলটা হলো কি? ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার প্রবাদটিই সত্যতা আবার প্রমাণ হলো। এটা ভাবা যায়, চট্টগ্রামে সংক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রলীগ অ্যাক্টিভিস্টদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুড়ে ফেলে, ছাত্রদের হাত পায়ের রগ কেটে দেয়। তাদের লাঠিপেটা করে এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে। ওই ঘটনায় ইতোমধ্যে একজন মারাও গেছেন, অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাত্রলীগ কর্মীদেরকে বের করে দেয়া হচ্ছে। কোটা আন্দোলনকারীদের ক্রোধ থেকে বাঁচতে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে রাতের আঁধারে বোরকায় ক্যামোফ্লাজ করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয়েছে। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনেক কক্ষ এক রকম গুড়িয়ে দিয়েছে কোটা আন্দোলনকারীরা। অতর্কিতে হামলার আগে এমন একটা দশা হতে পারে এটা কি ছাত্রলীগ ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিল? কোটা আন্দোলন রাজনৈতিক ভড়ং এ দুষ্টু নয়। অথচ এমন একটা গণআন্দোলনকে কী রাজনীতি দিয়ে দমন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ? অভিজ্ঞরা বলছেন, এখানেই তারা কৌশলগত বড় ভুল করেছে এবং ছাত্রলীগকে রীতিমতো ওই ভুলেরই খেসারত দিতে হচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের যে বয়স হয়ে গেছে এটা বোঝা যায়। বিভিন্ন পয়েন্টে কোটা আন্দোলনকারীদের হাতে ছাত্রলীগ অ্যাক্টিভিস্টরা মার খেয়েছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি হলো, আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের আগ বাড়িয়ে হামলা চালানোর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী ছাত্রলীগের পদ ছেড়েছেন। অনেক কর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদত্যাগ করা নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুসরাত জাহান সুরভী একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, ‘আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। আপনিও জানেন দেশে কী হচ্ছে। সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
চলমান আন্দোলনের আগে এমন করে নিজেদের দলীয় লোকজনের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে আমরা শুনিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রীতিমতো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন সাধারণ ছাত্ররা।
ছাত্রলীগ হাইকমান্ডকে ভাবতে হবে তারা কাদের জন্য আসলে রাজনীতি করছেন। কেবলমাত্র ছাত্রলীগের জন্য তাদের রাজনৈতিক কর্মধারা যদি পরিচালিত হয়, সেটি তো গণমানুষের অধিকারবোধকে কখনোই স্পর্শ করতে পারবে না।
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে কতটা বীতশ্রদ্ধ ও অনীহা থাকলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সরাসরি তাদেরকে ছাত্র হিসেবে অস্বীকার করতে পারে! ওই শিক্ষক যদি রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাদর্শীও হন, আমরা এর আগে কখনোই এমনটা দেখিনি যে বিএনপি আওয়ামী লীগকে পড়াবে না। ১৭ জুলাই নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এমনটা লিখেছেন- আমি উম্মে ফারহানা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, এ মর্মে ঘোষণা দিচ্ছি যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী সদস্যকে আর কখনো পাঠদান করাব না। আমার বিভাগের কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনোভাবে ছাত্রলীগের কোনো কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাহলে তারা যেন আমার ক্লাসে না আসেন। অন্য বিভাগে সাধারণত কোর্স নিই না, নিলে তাদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য হবে।
যারা লোভের বশবর্তী হয়ে নিরস্ত্র সতীর্থদের শারীরিক আঘাত করে তারা আমার ছাত্র হতে পারে না। এ নৈরাজ্য আর অরাজকতার মধ্যে আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে অন্তত এটুকু নিশ্চিত করতে চাই যে অন্যায় ও জুলুম যারা করে তাদের সঙ্গে আমার কোনো সংস্রব নেই। শিক্ষার্থীদের জয় হোক।
এই যে সাধারণ মানুষ ছাত্রলীগের মতো প্রভাববিস্তারী রাজনৈতিক সংগঠন থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃবৃন্দরা কি কিছু ভাবছেন? ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতৃবৃন্দ চাঁদাবাজি করে বড়লোক বনে গেছে। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে তারা চলেন। ভিন্নমতাদর্শীদের তারা মানুষ বলে মনে করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পুরোদস্তুর আধিপত্যবাদ কায়েম করেছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রাররা অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নির্দেশনা মেনে চলতে বাধ্য হন। অন্যথায় তাদের চাকরি থাকে না। ছাত্রলীগ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুন্দর ও সাবলীল সহাবস্থান পছন্দ করে না। বিস্তর অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের কমিটিতে বাছবিচার ছাড়াই নতুন সদস্য রিক্রুট করা হয়। চাহিদামাফিক অর্থ পেলে নতুন ছাত্রলীগ স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন থেকে এলেও সেটি নিয়ে কারো কোনো দ্বিধা বা দ্বিমত থাকে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন, আওয়ামী লীগের মটো, সেক্যুলারিজম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের হাইব্রিড ছাত্রলীগ কিছুই জানে না। এদের কাজই হলো সব সময় সবখানে দখলদারিত্ব বজায় রেখে নিজেদেরকে বিশেষ কিছু ভাবা। এমন হামবড়া ও কী হনুরে ছাত্র রাজনীতিকদের দিয়ে ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চলবে না- এ বোধ যতদিন না আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃবৃন্দরা বুঝবেন, ততদিন ছাত্রলীগের কাছ থেকে সভ্য আচরণ প্রত্যাশা করার কোনো অর্থ নেই। ছাত্রলীগকে বুঝতে হবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে বিরোধিতা ও বিভাজনের রাজনীতি ধোপে টিকবে না। তাদেরকে সত্য ও সুন্দরের পথে বিশুদ্ধতা অর্জন করতেই হবে। তা না হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো পরিস্থিতির স্বীকার তাদেরকে বারবারই হতে হবে।
এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ছাত্রলীগকে নিজেদের অতীত খুড়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনগুলো আরেকবার ফিরে দেখতে হবে। কোথায় তাদের অবস্থান ছিল, আর নিজেদের অহমিকা, গোঁড়ামি ও আধিপত্যবাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কোন অতলে নিমজ্জিত হচ্ছে তারা। ভুলের বৃত্ত ভেঙে হূত গৌরব ফিরিয়ে আনতে যদি না পারে তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে ছাত্রলীগ তাদের অস্তিত্বই হারাতে থাকবে। গণমানুষের অধিকার রক্ষায় ছাত্র রাজনীতি অতি অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু চরম আত্মস্বার্থ নিমগ্নতার কালে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেয়া হিতবাদী ছাত্রলীগ কি আমরা আর কোনোদিন ফিরে পাব?
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ