ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঘরছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীরা

প্রকাশনার সময়: ২৮ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪১

গত বছরের ২৮ আক্টোবরের পর রাজপথে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। তার ওপর কোটাবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে নয় মাসের মাথায় ফের নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দলটি। কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় সহিংসতার জন্য দলটির নেতা-কর্মীদের প্রতি অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বেশ কিছু শীর্ষ নেতাসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে গ্রেপ্তারের তালিকা। গ্রেপ্তার এড়াতে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন আত্মগোপনে। এদিকে গ্রেপ্তারের ভয়ে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও যাচ্ছেন না নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি বিএনপি।

কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরে জড়িতদের গ্রেপ্তারে গত কয়েক দিন দেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ দেয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোটা আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় শুধু রাজধানীতেই ২০০টির অধিক মামলা হয়েছে। এ মামলাকে কেন্দ্র করে রাজধানী বিভিন্ন এলাকার বাসা বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এসব অভিযানে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের অধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। এ অভিযানে যাদের আটক করা হয়েছে এদের সিংহভাগই হচ্ছে বিএনপি এবং জামায়াতের নেতাকর্মী। ফলে গ্রেপ্তার এড়াতে ঘর ছেড়ে এখন আত্মগোপনে রয়েছেন নেতাকর্মীরা। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ স্বাভাবিক না থাকার কারণে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা; যার কারণে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না নেতাকর্মীরা।

সূত্র জানায়, ৭ জানুয়ারির আগে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে মূলত ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। সেই অবস্থা থেকে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এ দলটি। নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন ঘিরে দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে জেলে যেতে হয়, এমনকি পুরোনো মামলায় অনেক নেতাকে সাজা দেয়া হয়। সে সময় গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতাকর্মীকে চলে যেতে হয় আত্মগোপনে। একদিকে সরকারে বিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়া, অন্যদিকে নির্বাচন ঠেকাতে না পারার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা নেমে আসে।

ওই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি ও নেতাকর্মীদের মনোবল ফেরাতে বেশ কিছুদিন ধরেই নানা পদক্ষেপ নিচ্ছিল বিএনপি। সাংগঠনিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ছাত্রদল, যুবদল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণসহ চারটি মহানগরের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হতে শুরু করে দলটি। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর বদলে গেছে সার্বিক পরিস্থিতি। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার জন্য সরকারের দিক থেকে বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। যদিও এ ধরনের অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কাল্পনিক বলছে বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জে পড়েছে বিএনপি। কোটা আন্দোলনেকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের ঘটনার জন্য বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়েছে, এ মামলায় দলটির বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে আটক করা হয়। এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে দলটির সব স্তরের নেতাকর্মী। গ্রেপ্তার এড়াতে ঘর বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছে নেতাকর্মীরা। কারণ বিভিন্ন স্থানে চলছে পুলিশি তল্লাশি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মোবাইল ট্র্যাক করে গ্রেপ্তার করতে পারে, এমন আতঙ্কে নেতাদের অনেকে মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন।

বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানেও গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। এ অভিযানে শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই টার্গেট করা হয়েছে। যাকে যেখানে পাচ্ছে, সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান গ্রেপ্তার অভিযানে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের বাসা বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাও রয়েছেন, যাদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন তাদের পরিবার ও আইনজীবী। তবে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে দলটির নেতাদের ধারণা। তারা বলছেন, ইন্টারনেট সংযোগ স্বাভাবিক না হওয়ায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এ কারণে গ্রেপ্তারের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে গত ১৬ জুলাই নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর দলটির কার্যালয় তালাবদ্ধ ও চারপাশে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ ফিতা টানিয়ে দেওয়া হয়। এখনো বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ, তবে নেই ‘ক্রাইম সিন’।

অন্যদিকে ঢাকা মহানগর ও ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়গুলোও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে নয়াপল্টন কার্যালয়ে কেউই আসছে না। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগরের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েও তা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্যরা জানান, ঢাকাসহ সব মহানগরের নেতাকর্মীদের প্রায় সবারই মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ রয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা এখন নতুন করে ঘরছাড়া।

গত কয়েক দিনে গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমানউল্লাহ আমান, জহির উদ্দিন স্বপন, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, কোষাধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান মিল্লাত, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব, সদস্যসচিব আমিনুল হক, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, বিএনপির যুববিষয়ক সহসম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তারিকুল আলম তেনজিং, সৈয়দ জাহাঙ্গীর হোসেন, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর, স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সাদ মোর্শেদ হোসেন পাপ্পা শিকদার। বিএনপি নেতাদের দাবি, কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় এরই মধ্যে আড়াই হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম উল্লেখ করে মামলা দেয়া হচ্ছে।

একইভাবে সারা দেশেও নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, হতাহতের ঘটনা আড়াল করতে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ‘ট্যাগ’ দিয়ে ছাত্র আন্দোলন ভিন্ন দিকে নিতে চাইছে সরকার। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকার সৃষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হত্যা-নির্যাতনের পর এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সাজানো মামলা দায়ের করে বিরোধী মতের নেতাদের গ্রেপ্তার করছে। তাদের আদালতে ওঠানোর আগেই নির্যাতন করে পঙ্গু করা হচ্ছে এবং বিচার বিভাগকে দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে আবারো নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেখানে রিমান্ডের ন্যূনতম আইন মানা হচ্ছে না। তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তারদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে কল্পকাহিনি রচনা করা হচ্ছে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ