ঢাকা, রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জনকারীরও রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস

প্রকাশনার সময়: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:১৪

সংস্কৃতির একটি অংশ হলো ধর্ম। বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে মারাত্মকভাবে। ধর্মকে মূলত ব্যবহার করা হচ্ছে অর্থ লাভের নিমিত্তে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংস্কৃতি আগ্রাসন যে হারে ঘটেছে, তার ফলে অধিকাংশ মানুষই হয়ে গেছে ধর্মান্ধ। ধর্মীয় বিশ্বাস আর মূল্যবোধ এমনভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে, অধিকাংশ মানুষ মনে করেন ধর্মযাজকদের বয়ানটাই জীবনে চলার অন্যতম পাথেয়।

তাই প্রাত্যহিক জীবনে ধর্মীয় রীতি নীতিকে ব্যবহার করে যাচ্ছে প্রতিটি মানুষ আর এ ব্যবহারটা ভুল না ঠিক তাও ভেবে দেখে না। ইসলাম ধর্মে আছে পাপ করে তওবা করলে সে পাপ মাফ হয়ে যায়। আরেকটি বিষয় ইসলাম ধর্ম পালনকারীরা বিশ্বাস করেন যে, হজ পালন করলে হজের আগের সব গুনাহ মাফ হয়। প্রকৃতার্থে কি তা মাফ হয়। তবে প্রচলিত কথা চালু আছে হজ (ওমরাহ বা পূর্ণ হজ) করলে হজের পূর্বে জীবনের পাপগুলো মাফ হয়ে যায়। যাই হোক, প্রতিটি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসবোধটা এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে (নেতিবাচক হিসেবে)। যেমন কিশোরগঞ্জের আলোচিত পাগলা মসজিদ। এ মসজিদে আছে একটা দান বাক্স। যখন দান বাক্সের সিন্দুকটি খোলা হয়, তখন তার ভিতর দেখা যায় কোটি কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণালঙ্কার। দেশে দুর্নীতি করে অর্থোপার্জন করার হারটা বেড়েছে। প্রতিটি দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ার ভয়ে থাকে। আবার দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জনকারীরও রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস। তারা মনে করে দুর্নীতি করে উপার্জকরা টাকা দান করলে সেই উসিলায় মাফ পেয়ে যাবে। আবার তাদের বিশ্বাস দান বাক্সে দান করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। প্রতিটি দুর্নীতিবাজদের মনের ইচ্ছা থাকে যাতে তারা ধরা না পড়ে। এ ধরনের ইচ্ছাটা যাতে সফল হয় তাই তারা টাকা দান করে বাক্সের মধ্যে। এভাবেই দুর্নীতি করে অর্থোপার্জনকারীরা স্রষ্টার রাস্তায় টাকা বিলোয়। এসব কারণে দেখা যায় পাগলা মসজিদে সিন্দুকে টাকা জমা পড়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।

এ বছরের শুধুমাত্র এপ্রিল মাসে পাগলা মসজিদের দান বাক্সের সিন্দুকটা খোলা হয়। এপ্রিল মাসে পাওয়া গেছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা। পাগলা মসজিদের দান বাক্সে সব ধর্মের মানুষ ইচ্ছা পূরণের লক্ষে দান করে থাকে। এত টাকা দান বাক্সে জমা হয় কি করে, কারা এত দান করতে পারে। বর্তমানে অফিস আদালতে, মাদক চালানসহ নানা ধরনের অনিয়ম বেড়ে গেছে। আর এ ধরনের অনিয়ম করে এক শ্রেণির মানুষ অর্থ সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠছে।

যেহেতু এদের আয় অবৈধ তাই তারা নিজেকে রক্ষার জন্য পাগলা মসজিদের সিন্দুকে দান করে। শোনা যায় পাগলা মসজিদটি ঈসা খা’র আমলে নির্মিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যাবে যে, গত এপ্রিলেই ছিল মসজিদ তৈরির পর সর্বোচ্চ অর্থ জমা। সেই সঙ্গে ঈসা খা’র আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দুর্নীতিটার হিসাব করলে কি পাওয়া যায়, ঈসা খা’র আমলের চেয়ে হাজার গুণ দুর্নীতি এখন বেড়েছে সমাজে। তাই দানের পরিমাণটাও বেড়েছে। দেশের দুর্নীতিবাজরা মনে করেন অসৎভাবে উপার্জিত টাকা দান করলে পাপটা মোচন হবে।

তাই অবৈধ আয়ের একটা অংশ তারা দান করেন। অনেকটা আয়কর দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার মতো তাদের চিন্তা। আসলে এ দানে পাপ মোচন হয়। বিসিএস প্রশ্নফাঁসকারী আলোচিত ব্যক্তি পিএসসির ড্রাইভার আবেদ আলী। তিনি ড্রাইভার থেকে থ্রি স্টার হোটেলের মালিক। তিনি নিজেও জানেন না যে তিনি কত হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন, প্রশ্ন ফাঁস করা ব্যবসার মাধ্যমে। একটি গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, আবেদ আলী বলেছেন যে, প্রশ্ন ফাঁস করে আয় করা অর্থ তিনি আল্লাহর রাস্তায় দান করেছেন। ছাগল কাণ্ডের অন্যতম নায়ক মতিউর। তিনি মক্কায় গিয়ে হজ করেছেন, প্রিয় নবীর মাজার জিয়ারত করেছেন। প্রতি বছর নামি দামি গরু ছাগল কোরবানি দিয়েছেন আল্লাহর রাস্তায়। তিনি মনে করতেন এ পন্থায় তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তার দুর্নীতি কখনোই ধরা পড়বে না। বাংলাদেশ থেকে হজ পালনকারীর সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। প্রতি বছর ওমরাহ ও হজে প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ সৌদি আরব গিয়ে থাকেন। এমন কিছু ব্যক্তি আছে তারা প্রতি বছরই ওমরাহ করে আসেন। হজ পালন নিয়ে এবং কোরবানি নিয়ে অনেক কথাই আছে। যেমন একজন সরকারি কর্মচারী নানা পন্থায় টাকা আয় করেন। অবৈধ পন্থায় আয় করা টাকা দিয়ে সংসারের খরচ ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালান।

তার নির্দিষ্ট বেতনের টাকাটা জমা রাখেন। বছরে যখন কোরবানি দেয়ার সময় আসে তখন তারা জমানো বেতনের টাকা দিয়ে কোরবানি দেন। তিনি মনে করেন তিনি হালাল টাকা দিয়ে কোরবানি করেছেন। অনুরূপ ঘটনা ঘটে হজ পালনের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের মাঝে আগের চেয়ে ধর্ম পালনের বিষয়টি বেড়েছে বহু গুণ। আজ থেকে ২০ বছর আগেও ইসকনের এত রমরমা অবস্থা ছিল না। সরকারের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বেড়ে যাওয়ায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো এখন জাঁকজমকপূর্ণ হচ্ছে। আজ থেকে ২০ বছর আগে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে রথ যাত্রা, দুর্গোৎসব পালন করা হতো তার স্বারম্ভরতা বেড়েছে এখন বহু গুণ। দুর্গোৎসবের মন্দিরের সংখ্যাও আগে চেয়ে বেড়েছে কয়েক গুণ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করলে কিছু পাপ মোচনের কথা বলা আছে সব ধর্মের কিতাব বা গ্রন্থগুলোতে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুর্নীতিবাজরা ধর্মীয় আচারাদি পালন করে গুনাহ বা পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য। সারা দেশে অসমর্থিত স্যাম্পল বেসিস একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মন্দির, মসজিদ, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব পালনকারী সভাপতি পদটিতে যারা আছেন, তাদের শতকরা প্রায় ৮০ শতাংশ কোনো না কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। একটা ছোট উদাহরণ দিচ্ছি। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার চাপড়বাড়ী গ্রামে ৪০ বছর আগে একটি ছোট জুম্বা ঘর ছিল। তখন এ গ্রামটিতে কোনো প্রকার অনিয়ম বা অনৈতিক কাজ হতো না। বর্তমানে গ্রামটিতে পাঁচটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সামাজিক অস্থিরতা ওইসব সময়ের চেয়ে বেড়েছে কয়েক গুণ। যারা এখানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তাদের নৈতিক চরিত্রটা প্রশ্নবোধক? এদের অর্ধেকেরও বেশি নানা ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্ত। ধর্মটা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় আচ্ছাদনে ঢেকে কেউ হচ্ছে সামাজিক নেতা আবার কেউ ঢাকছে দুর্নীতিটা ধর্মের চাদর জড়িয়ে। রাজস্ব বোর্ডের আরেক কর্মকর্তা, তিনি দ্বিতীয় সচিব পদমর্যাদার একজন। উনার নাম আরজিনা, তিনি সব সময় হিজাব পরিধান করেন। আরজিনা একজন পর্দানশীল মহিলা।

রাস্তাঘাটে তাকে দেখে কেউ চিনতে পারবেন না কারণ তিনি দেহটা সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখেন। তিনি শরিয়ত মোতাবেক নিজের শরীরটা এমনভাবে ঢেকে পুরুষের সামনে আসেন যে, তাকে দেখে মনে হবে তিনিই আরজিনা কারণ তার সারা দেহ ঢাকা আচ্ছাদনে। প্রকৃতভাবে বোঝা যাবে তিনি একজন মহিলা। এ ধর্মীয় লেবাসধারী কত বড় দুর্নীতিবাজ তা যদি দুদকের জালে ধরা না পড়ত তাহলে কেউ বিশ্বাস করতেন না এ মহিলা দুর্নীতি করতে পারে। তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন অবৈধভাবে উপার্জন করে। ৫০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার রয়েছে তার, যা প্রায় সাত কেজি ওজনেরও বেশি। মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দাম দুই কোটি টাকা, গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলাতে। ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে বানিয়েছেন আলিশান অট্টালিকা, কিনেছেন শত বিঘা সম্পত্তি। তার মতো আরেকজন মহিলাকে দেখা যায়, রাজশী জেলার এলজিইডি গোদাগাড়ির উপজেলার নকশাকার (উপসহকারী প্রকৌশলী) হিজাবিকে। তার নাম রওশানারা আখি। তিনি ধার্মিক তাই শরিয়ত মোতাবেক চলেন।

তবে অবৈধ আয়ের পথ বের করতে তার জুড়ি মেলা ভার। হরিংশংকপুর ঈদগাহের আড়াই লাখ টাকার কাজে তাকে ঘুষ দিতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তার তত্ত্বাবধানে থাকা প্রতিটি কাজে তিনি এভাবে ঘুষ নেন। অথচ তাকে দেখে বুঝতে পারবে না কেউ তিনি কত বড় দুর্নীতিবাজ। কারণ ইসলামি লেবাসে সারা শরীর তিনি ঢেকে রাখেন। অথচ তিনি উৎকোচ গ্রহণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় উপাসনার জন্য ব্যবহূত ঈদগাহ মাঠকেও ছাড়েনি। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের উচিত প্রতিটি অফিসের নির্দিষ্ট ড্রেস কোড করে দেয়া, এ কোডের বাইরে কেউ পোশাক পড়তে পারবেন না। এটা করলে ধর্মীয় আচ্ছাদন ব্যবহার করে কেউ দুর্নীতি করতে পারবে না। অফিস ভবনে ধর্মীয় আরাধনাটা বন্ধ করা। অফিসের অদূরে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ