গত ১২ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। সারা দেশে এ ধরনের অন্তত পৌনে ২ লাখ মোবাইল ফোন নাম্বার শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। নাম্বারগুলোতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মালায়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের পাশাপাশি দেশে বসেও টাকা পাঠানো হয়।
এক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মকে। বেশিরভাগ নাম্বার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে রেজিস্ট্রেশন থাকার কারণে ধারণা করা হচ্ছে ওইসব টাকা নাশকতার পেছনে ব্যয় হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যক্তিকে দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হতে পারে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে গত ১২ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত অন্তত পৌনে ২ লাখ মোবাইল ফোন নাম্বারে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। সিআইডির ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম ইউনিট প্রথমে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কিছু নাম্বার শনাক্ত করে দ্রুত তা বন্ধ করে দেয়ার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অপারেটরদের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পেয়ে অন্তত ৪০ হাজার নাম্বারের লেনদেন তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেয়া হয়।
ওই নাম্বারের তালিকাও পাঠানো হয়েছে সিআইডিতে। এছাড়া বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকেও (এমএফএস) নজরদারীতে রাখা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির শনাক্ত করা নাম্বারে গ্রাহকের বিষয়ে তথ্য নিতে গিয়ে দেখা গেছে বেশিরভাগই বিএনপির নেতাকর্মী। তাদের এনআইডি নাম্বারগুলো পুলিশের ক্রিমিনাল ডেটাবেইজ সেন্টরে পাঠানো হলে দেখা গেছে অনেকের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতার কাছেও ওই টাকা পাঠানো হয়েছে। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে, টাকাগুলো আন্দোলনের নামে নাশকতার পেছনে ব্যয় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আসা টাকাগুলো এসেছে হন্ডির মাধ্যমে। একই সঙ্গে দেশে বসেও এজেন্ট নাম্বার থেকে টাকা দেয়া হয়েছে। ফলে গ্রাহকের সন্ধান পাওয়া গেলেও প্রেরক থাকছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে টাকা উত্তোলন ও প্রেরকের এনআইডি নাম্বার সংগ্রহ করতে অপারেটরদের বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। যদিও আগে থেকেই এ নিয়ম চালু ছিল। কিন্তু অনেক অপারেটর এ আইন মানছে না। এ কারণে এজেন্ট নাম্বারধারী গ্রাহককেও আইনের আওতায় আনা হতে পারে। এর আগে রেমিট্যান্সের টাকা হন্ডিতে আসায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এরপর অনেকে সচেতন হলেও আবারও পুরোনো চেহারায় ফিরে গেছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে সিআইডিকে ৪০ হাজার নাম্বারের তালিকা দেয়া হয়। পরে সিআইডির পক্ষ থেকে তদন্ত করতে গিয়ে এর সংখ্যা পৌঁনে দুই লাখ ছাড়িয়ে যায়। সেখানে দেখা গেছে, কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে মাত্র ৭ দিনে। একদিনে এক একটি নাম্বারে দিনে অন্তত ২৫ হাজার থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ১০ হাজার পর্যন্ত টাকা ক্যাশ ইন হয়েছে। দেশ ছাড়াও ওইসব নাম্বারে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা টাকা পাঠিয়েছেন। নাম্বারগুলোর বেশিরভাগই বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
জানা গেছে, এসব নম্বরের মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি শুধু ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। এবং মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি ‘ক্যাশ আউট’ হয়েছে। প্রতি মিনিটে চারটি বা তার বেশি ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে রাত ২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে। এ টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে বিদেশ থেকে। এছাড়া দেশ থেকেও পাঠানো টাকাগুলো বিকেল থেকে রাত ৮ টাকার মধ্যে ক্যাশ ইন ও আউট করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, টাকাগুলো বিএনপি-জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেছে। কারণ এর আগেও অভিযোগ উঠেছিল টাকার বিনিময়ে বিএনপি তাদের অনুষ্ঠানে লোক ভাড়া করার। একই সঙ্গে ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া ও থাক-খাওয়ার পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এছাড়া এবার সহিংসতায় বস্তি ও টোকাইদেরও ভাড়া করা হয়েছে। তারাই বেছে বেছে সরকারী স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। ওইসব কাজে টাকাগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারণ ১২ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ওইসব নাম্বারে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। বাকি সময়গুলোতে তেমন লেনদের তথ্য নেই।
সূত্রমতে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতের অনুপ্রবেসের পর বিদেশে অবস্থানরত বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরাও নড়েচড়ে বসে। তারা বিভিন্ন দেশে মিছিল মিটিং ও সমাবেশ করে। একইসঙ্গে দেশে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল। ওইসব বিএনপি-জামায়াতের প্রবাসীরা বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যেমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠানো শুরু করে। এ সুযোগটি গ্রহণ করে হন্ডি ব্যবসায়ীরাও। তারা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছে অ্যাপ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের সুবিধাভোগীর এমএফএস অ্যাকাউন্ট নাম্বার ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে এসএমএস পাঠায়। এরপর দেশ থেকে এজেন্ট নাম্বারের গ্রাহকরা কঙ্ক্ষিত নাম্বারে ক্যাশ ইন করে দিয়েছে। এছাড়া অনলাইন গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এমএফএস এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে।
সিআইডির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সন্দেহভাজন লেনদেনগুলো বেশিরভাগই ঘটেছে গভীর রাতে। এবং ক্যাশ আউট হয়েছে দিনের বেলায়। সাধারণত প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে (এমএফএস) বেছে নিয়েছে। আর ওই প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পাঠানোর জন্য গভীর রাতকে বেছে নিয়েছে। তারা টাকা পাঠানোর পর সুবিধামতো সময়ে গ্রাহক তার টাকা তুলে নিয়েছেন। এ কারণে রাতে ব্যক্তিগত নাম্বারে অস্বাভাবিক লেনদেন চোখে পড়তে তাৎক্ষণিক তা জানানোর জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্তদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সিআইডির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএফআইইউর কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর তারা মাঠে নেমে সত্যতা পান। এরপর অনেককেই ডেকে পাঠানো হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নামে এজেন্টশিপ দেয়া হয়েছে তার কোনো অস্বিত্ব নেই। সাধারণত একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এজেন্ট দেয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মুরগী ব্যবসায়ীর কাছেও এজেন্ট নাম্বারের অস্বিত্ব পাওয়া গেছে।
এ কারণে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরও নাশকতার পেছনে অর্থ ব্যয়কারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, নাশকতার পেছনে অর্থদাতাদের শনাক্ত করতে কাজ করছে সিআইডির ফাইন্যানশিয়াল ইউনিট। তারা বেশকিছু মোবাইল ব্যাংকিং নাম্বার শনাক্ত করেছে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হবে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ