ঢাকা, রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আমার বাঙালি আজ মানুষ

প্রকাশনার সময়: ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৯

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে বলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’! একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও অকুতোভয় বাঙালির অবিসংবাদিত স্লোগান ছিল আমি কে? তুমি কে? বাঙালি, বাঙালি!

১০ জানুয়ারির ভাষণ দানকালে আবেগের আতিশয্যে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে তিনি সেদিন বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ।’

ভুমিকায় এত কথা বলার কারণ হলো, হাজার বছরের শোষণ বঞ্চনার পর লাখো বীরের আত্মত্যাগে একাত্তরে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটি স্বাধীনতা লাভ করলে এ জাতিগোষ্ঠী তার ‘মানুষ’ নামকে মহিমান্বিত করে। সেই মানুষ ২০২৪ এর ১৪ জুলাইতে এসে নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় রাজাকার অভিধায় অভিষিক্ত করে কিভাবে? তাও এমন এক জায়গা থেকে এই স্লোগানটি উঠল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। স্বাধীনতা ঘোষণার কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় শহীদদের প্রথম বধ্যভূমিতে।

একাত্তরের বীর শহীদেরা! আপনারা কি সেই রাতের স্লোগান শুনতে পেয়েছেন, যারা হয়ে উঠেছিল আপনাদের হন্তারক তাদের নামে জয়ধ্বনি হলো? মাত্র তিপ্পান্ন বছরের ব্যবধানে আপনাদের উত্তরসূরীরা গলায় বারুদ নিয়ে বলছে, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার! হানাদারের আগ্রাসন থেকে দেশ বাঁচাতে একাত্তরে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন সেই বীরশ্রেষ্ঠদের কথা নাইবা বললাম। গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া অবুঝ মানুষ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বলতে বলতে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন; সেই তাদেরকে বোমা, গুলি, বেয়নেটে মৃত্যুদণ্ড লিখে দেয়ার ভয় দেখিয়ে যদি কোলাবোরেটররা বলত, নিজেকে রাজাকার বললে বাঁচিয়ে দেব, রাজি হতো বীরেরা? কস্মিনকালেও না।

রাজাকার শব্দ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে আলাদা ব্যাখ্যার এতটুকু সুযোগ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থেকে উঠে আসা রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অক্সিলারী ফোর্সের নাম যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্পষ্টত জেনোসাইড ঘটাতে অংশ নিয়েছিল। আজকের দিনে সবাই জানে জেনোসাইড একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। এ সরল ও অতি সাধারণ কথাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের না বুঝবার কথা নয়। ১৪ জুলাইতে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বলেছিলেন? মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সমাবেশ থেকে পরদিন সকালে স্লোগান আসছে, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কে বলে রে রাজাকার, ধিক্কার ধিক্কার’, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, প্রত্যাহার করতে হবে’। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু গেল রাতে ঢালাওভাবে সবাই একজোট হয়ে যখন ঘোষণা দিয়েছে, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার! এটা স্পষ্টতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল মর্ম ও চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসভঙের শামিল। সাংবিধানিক বাংলাদেশ মানলে কোনো সুসভ্য নাগরিক নিজেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার নামের সঙ্গে নিজেকে অঙ্গীভূত করার অধিকার রাখে না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে বহু কার্যকর ও শালিন ভাষা প্রয়োগ করা যায়। তা না করে এক নিমিষে নিজেদেরকে স্বাধীনতাবিরোধীদের কাতারে নামিয়ে দেয়া চরমমাত্রার গোঁড়ামি ও বালখিল্যতা। কোনো ফিলানথ্রোপিস্ট রাজাকারের প্রতি সংহতি জানাতে পারে না। অথচ কোটা সংস্কারের দাবিটা ন্যায্য ও সময়োপযোগী। সরকারী চাকরীতে ৫৬ ভাগ কোটা রাখা হবে নাকি কমিয়ে আনা হবে তা নিয়ে অতি অবশ্যই দাবীভিত্তিক আন্দোলন হতে পারে। সংস্কার হতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার মৌল স্পিরিটকে পায়ে দলে বাংলাদেশের নাগরিক দাবী করবার নৈতিক ভিত্তি থাকে না। এটা যত তাড়াতাড়ি আন্দোলনকারীরা বুঝবে হয়ত তাতেই সবার মঙ্গল। অপরদিকে একাত্তর ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর ছাত্র রাজনীতি বা আন্দোলন দিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের ইতিহাস খুব বেশী ইতিবাচক নয়। গেলবারের কোটা আন্দোলনকারী নুরুল হক নুরুদের নিয়ে বহুমাত্রিক অভিযোগ রয়েছে। নির্দিষ্ট আদর্শের ধার না ধেরে বিচিত্র জীবনযাপন করে তারা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এবারের আন্দোলনে যদিও একক কাউকে মুখপাত্র নির্বাচন করা হয়নি। তারপরও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়াদের ভবিষ্যৎ কর্মধারাই তাদের জাত চিনিয়ে দেবে।

গণতান্ত্রিক নিয়মে একজন মানুষও যদি ন্যায্য দাবী নিয়ে আসে তার কথাও রাষ্ট্রের কর্ণধাররা শুনতে বাধ্য। এ অর্থে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকারের মুখ ঘুরিয়ে রাখার সুযোগ নেই। আমরা বলব, সরকারের নীতিনির্ধারকদের এমন কোনো কথা বলে সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত নয়, যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দেশাত্মবোধবিরোধী ভুল করে বসে। দায় আমাদের সবাইকেই নিতে হবে। ভাবতে হবে কেন নতুন প্রজন্মের বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজেদেরকে রাজাকারের যোগ্য উত্তরসূরী ভেবে গর্ব বোধ করছে। কেন রাজাকার নামের দুর্মর বিষাক্ত শব্দটিকে নিজেদের জন্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জ্ঞান করছে? এটা কি আদৌ কোনো ভালো লক্ষণ?

আমরা কড়া প্রশ্ন করব— কেন বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমুখী সমাজ কায়েমের মাধ্যমে সব মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐকতানিক ছাতাতলে আনা গেল না? কেন সর্বমানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করতে পারবে না?

কেন বঙ্গবন্ধুর ‘আমার বাঙালি আজ মানুষ’ তকমাটি ধরে রাখা গেল না? কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদেরকে দল থেকে অবমুক্ত করে রাজাকার বলে স্লোগান দেয়? এ বিস্ময়কর অবনমন থেকে কারা আমাদেরকে মুক্তির বার্তা দেবে?

আমরা মনে করি রাজনৈতিক পরিশুদ্ধতা, আইনের শাসন, বিজ্ঞানমনস্ক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিনির্ভর সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করার অভিলাষ যদি শাসকশ্রেণির মধ্যে না আসে, ততদিন আসলে মানুষ হিসেবে আমাদের মুক্তি অসম্ভব। শেষের কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেমন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রতি মনোযোগী হতে হবে, তেমনি আন্দোলনকারীদেরও রাজাকার বিভ্রম থেকে নিজেদেরকে অতি অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। আন্দোলনের হট্টগোলের নামে সরকারকে আমরা এমন সুযোগ যেন দিয়ে না বসি যাতে ঢালাওভাবে তাদের সব কর্মকাণ্ড Legitimacy পেয়ে যায়। ক্ষণে ক্ষণে ক্রমবিবর্তিত ইস্যুর মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ যেন তৈরী হতে না থাকে। ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের পর কোনো পর্যালোচনা ছাড়া হঠাৎ সিদ্ধান্তে সব কোটা বন্ধ করে দেয়ার পরিপত্র জারি করা যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না, তেমনি আরেক দফা হুট করে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনাও ন্যায়সঙ্গত নয়। আমাদের সব পক্ষকে সহনশীল আচরণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোজগত বুঝে দায়িত্বশীলদের কাজ করতে হবে। ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দায়টা সবার আগে ক্ষমতাসীন সরকারের।

সব শুভবোধের পতনের আগে তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী মনে রাখতে পারে, ‘জনাব নুরুল আমিন কত বড় অপরিণামদর্শী কাজ করলেন! গুলি ছুড়লেন, তাও আবার ছাত্রদের উপরই? মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে।’

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ