মাদকের করাল গ্রাসে ভাসছে বাংলাদেশ। কোনোভাবেই বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দিন দিন বেড়ে চলছে মাদকের আগ্রাসন। মাদকের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার বারবার চেষ্টা করলেও কোনো সুফল আসছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর ভূমিকা নিলেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মাদকের ছড়াছড়ি। মাদক ব্যবহারকারী ও মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশলে তাদের মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাকে গতিশীল করার জন্য দিন দিন বিভিন্ন পথ পদ্ধতি অবলম্বন করছে। মাদক ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে নারী ও স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরকে তাদের ব্যবসার পার্টনার হিসেবে ব্যবহার করছে। সমাজ বা রাষ্ট্রে এমন কিছু লোক মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে যাদেরকে দেখলে সাধারণ মানুষ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন কখনোই বলতে পারবে না তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
মূলত এসব লোকের মাধ্যমে মাদকের সরবরাহ সবচেয়ে বেশী হয়ে থাকে। তারা এলাকায় ভালো লোক বা গণ্যমান্য লোক হিসেবে পরিচিত। এসব লোক মাঝে মধ্যে মাদক ব্যবসার সঙ্গে পুলিশের বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ধরা পড়লেও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে তারা পার পেয়ে যায়। মাদকের চলমান অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বাংলাদেশের জন্য হুমকী হয়ে দাঁড়াবে। মাদক বন্ধ করতে হলে আমাদেরকে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা একটা জিনিস প্রায় লক্ষ্য করে থাকি আমাদের দেশে যেসব পুরুষ নারী কোনো কোম্পানী বা গার্মেন্টস সেক্টরে চাকরী করে তারা সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি বা কাজ শেষে ছুটি হলে বের হয়ে বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালবেলা আবার তাদের কাজে যেতে হবে এজন্য তারা ব্যস্ত থাকে। তারা কোনোভাবেই মাদক বা অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই দেশের প্রতিটা লোক যদি কর্মের মধ্যে অবস্থান করে তাহলে দেখা যাবে মাদক অনেকটা কমে গেছে এক সময় মাদক শূন্যের কোঠায় চলে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তি এখন অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এটি জাতির পঙ্গুত্বের খুব বড় একটা কারণ। সাধারণত ১৫ থেকে ৩৫ বছরের বয়সের উপস্থিতি ৭০ ভাগ। আর মাদক গ্রহণের গড় বয়স ২২। এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো মাদকের পেছনে ব্যয় হয়। এ টাকার বেশীরভাগ অংশ চলে যায় ভারতে। কারণ ফেনসিডিল কিংবা ইয়াবা এ দেশে উৎপাদিত হয় না। ফেনসিডিল ভারত থেকে এবং ইয়াবা মিয়ানমার থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আসে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চক্র বড় জায়গা করে নিয়েছে। সরকারের মাদকবিরোধী লড়াই সত্ত্বেও থেমে নেই মাদক ব্যবসা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া অবস্থানে পাচারকারীরা পাচারের কৌশল পাল্টে চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা। আফসোসের বিষয়, নেশার কবলে লাখ লাখ তরুণ তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে ধ্বংসের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। তারা কর্মশক্তি, মেধা ও সৃজনশীলতাকে হারিয়ে ফেলে ভয়ঙ্কর ফাঁদে পা ফেলছে। পুরুষদের মাঝে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেশী দেখা গেলেও এখন নারীরাও পিছিয়ে নেই। মাদক কেনার টাকা না পেয়ে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে খুন হচ্ছেন বাবা-মা। ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছেন ভাই বা বোন। টাকা না পেয়ে মায়ের অলঙ্কার চুরি করে তা বিক্রী করে দিচ্ছে মাদকাসক্ত ছেলে। কেউ কেউ চাঁদাবাজী বা ছিনতাই করছে। আবার কেউ করছে শিশু অপহরণ। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে মাদক কিনবে। এভাবে মাদকের কারণে তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে।
মাদক ব্যবসা ও সেবনকে কেন্দ্র করে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজীর ঘটনাও ঘটছে। প্রতিদিনের পত্রিকা খুললেই এসব চোখে পড়ে। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ধূমপান চলে, বড় বড় রেস্টুরেন্টে পার্টিতে প্রকাশ্যে মাদক সেবন ছাড়াও অন্যান্য অনৈতিক কাজ চলে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন এবং জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেবেন বলে জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে রয়েছে পুলিশের তৎপরতা। এত কিছুর পরও মাদকের আগ্রাসন কমছে না। মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেক অঘটন এড়ানো যেত।
মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই রাষ্ট্রের। তবে শুধু রাষ্ট্রকে দোষারোপ করলে চলবে না। এর পেছনে পরিবার ও সমাজ অনেকখানি দায়ী। বাবা-মা সন্তানদের প্রতি প্রকৃত অর্থে দায়িত্বশীল হলে তারা মাদকে আসক্ত হতে পারে না। সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের উদাসীনতা তাদের মাদকের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ ছাড়া সামাজিক বৈষম্যের কারণে অনেক তরুণ, যুবক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মাদক থেকে এর মুক্তি খোঁজে। গডফাদাররা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গা ঢাকা দেয়ার ফুরসত পায়। তাই আইনী সমস্যায় পড়তে হয় কর্তৃপক্ষকে, তাদের পেছনে লাগলেও প্রমাণ পাওয়া যায় না। গডফাদারদের কথা সরকার জানে। তাদের হয় শাস্তি দিতে হবে অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
কাজেই রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকেও সচেতন হতে হবে। সন্তানের গতিবিধি এবং বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর রাখতে হবে। সন্তান যে জায়গাগুলোতে সব সময় যাওয়া আসা করে সেই জায়গাতে খোঁজখবর নিতে হবে। তার সঙ্গে আচরণ করতে হবে বন্ধুর মতো যেন বাহিরে কোনো সমস্যা হলে সে নিজের থেকেই পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করে। সন্তানদের সামাজিক, মানসিক, লেখাপড়া সংক্রান্ত অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো যথাসম্ভব মেটাতে হবে, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দিয়ে তাদের প্রত্যাশা বাড়তে দেয়া যাবে না। মাদকমুক্ত সমাজ জাতিকে এক সুন্দর ভবিষ্যৎ দেবে। তাই আসুন সবখানে সব অবস্থায় মাদককে না বলি। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করি। মাদক বন্ধ করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষক ইমামদেরকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ