ভিন্ন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে কোটাবিরোধী আন্দোলন। একদিকে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার, অন্যদিকে ছাড় দিতে নারাজ আন্দোলনকারীরা। ইতোমধ্যে শাহবাগ থানায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নতুন ঘোষিত এক দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ফের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তারা। কোটা সংস্কারের এক দফা দাবীতে বঙ্গভবন অভিমুখে গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেবেন শিক্ষার্থী ও চাকরী প্রত্যাশীরা। আজ রোববার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে এই পদযাত্রা শুরু হবে। গতকাল শনিবার দেয়া নতুন কর্মসূচিতে সড়ক অবরোধের ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে সরলেও সারা দেশে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ছাত্র ধর্মঘট অব্যাহত থাকার ঘোষণা এসেছে।
এদিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের এক জন হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের কর্মসূচি থাকবে, জাতীয় সংসদে জরুরী অধিবেশন ডেকে সরকারী চাকরীতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের লক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং গণপদযাত্রা। এ গণপদযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেবেন। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণপদযাত্রা করে নিজ নিজ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবেন।’
আন্দোলনকারীদের এক দফা দাবী হলো— ‘সকল গ্রেডে সকল প্রকার অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে।’ সরকারী চাকরীতে কোটার বিরোধিতা করে গত কয়েক দিন থেকে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থী ও চাকরী প্রত্যাশীরা। হাইকোর্টের রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ক্রমে ছড়িয়ে যায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচির পাশাপাশি শাহবাগে সড়ক অবরোধ করতে থাকে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা গত সপ্তাহে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে। রোববার ও সোমবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ‘বাংলা ব্লকেড’ পালন করে এক দিন বিরতি দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। পরের দুই দিন আবার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ করে। শুক্রবার নিজেদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। কোটার বিরোধিতায় চার দফা দাবীতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন এখন এক দফায় এসে ঠেকেছে।
গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শনিবার পুলিশের মামলা, কোটা সংস্কার আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের মধ্যে শনিবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করলেন আন্দোলনকারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের এক জন হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি সলিউশন বিকল্প কখনোই সাপ্রেশন নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি পুলিশ ব্যবহার করে আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের চলমান ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিকে জনভোগান্তির কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই, যদি প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারেন, তাহলে পৃথিবী একটি সন্তান বিবর্জিত হতো। সুতরাং সুন্দর পৃথিবীর জন্য সাময়িক প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।’
আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সরকার আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনটিকে দমনের পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবী জানিয়ে সরকারের করণীয় বলে আসছি। তারা আমাদের দাবী পূরণে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কিন্তু তারা সেটি না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে দমনের পরিকল্পনা করছে। এর মাধ্যমে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরী হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে এবং তা সরকারের জন্যই বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত থাকবে বলে জানান আরেক সমন্বয়ক শারজিস আলম। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা যখন যৌক্তিক দাবী নিয়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেছেন তখন কিন্তু শিক্ষার্থীরা জোর করে ক্লাসে গিয়ে বসে থাকিনি। তারা আপনাদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে। আপনাদের দাবী পূরণ হয়ে গেলেও আমাদের দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ক্লাস পরীক্ষায় নেয়ার জন্য জোর করবেন না।’
এ সময় কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়ার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটামও দেয়া হয়েছে।
কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ রোববার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে এই গণপদযাত্রা শুরু হবে। গণপদযাত্রা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে গিয়ে সেখানে স্মারকলিপি প্রদান করবে। গণপদযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ, শের-ই বাংলা কলেজসহ ঢাকার সব প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করবে বলে জানান নেতারা। এছাড়া দেশের প্রতিটি জেলার আন্দোলনকারীরা নিজ নিজ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবেন। সেই সঙ্গে জেলায় জেলায় গণপদযাত্রাও পালিত হবে।
ছাত্রদের আন্দোলন থামানো উচিত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
দেশব্যাপী চলমান কোটা সংস্কারের দাবীতে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘আমি মনে করি, তাঁদের (ছাত্রদের) একটু অপেক্ষা করা উচিত, আন্দোলন থামানো উচিত। কারণ, পৃথিবীর সব জায়গায় কিন্তু কোটা রয়েছে। সব দেশেই কিছু অনগ্রসর জায়গা থাকে, যেমন আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা রয়েছে এবং সংবিধানেও সেটি বলা আছে। এটি বাতিল করে দিলে এরা কোনো দিন সমাজের মূল স্রোতে আসতে পারবে না। আমরা মনে করছি, সবাই যেন একসঙ্গে চলতে পারে।’ শনিবার দুপুরে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন শেষে সুধী সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বেলা দুইটায় তিনি ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনসে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এর আগে তিনি জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানার ১১টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এরপর ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ: ময়মনসিংহ জেলা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন এবং সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
কোটা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেয়ার অপকৌশল হচ্ছে: আব্বাস
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা টেনে সরকার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন যারা করছে তাদের দাবী-দাওয়া ন্যায্য। বিএনপি এর সঙ্গে আছে বলে সরকার যে কথা এখন বলেছে, এসব কথা বলে আসলে বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। ‘এটা তাদের (সরকার) একটা অপপ্রয়াস, অপকৌশল এ আন্দোলনকে অন্য দিকে ধাবিত করার জন্য। আমরা ভয় পাচ্ছি আন্দোলনের ফাঁক দিয়ে আবার অন্য কোনো অপকর্ম তারা (সরকার) করছে কিনা, এদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করছে কিনা।’ শনিবার রাজধানীর শের-ই বাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
আন্দোলনে অন্য কেউ ইন্ধন দিতে পারে: ডিবি প্রধান
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্য কেউ ইন্ধন দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, কেউ যদি আদালতের আদেশ না মানে, পুলিশের কথা মানে, আন্দোলনের নামে জানমালের ক্ষতি করে, সড়ক অবরোধ করে তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে যৌক্তিক কাজ সেটাই করা হবে। শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন ডিবি প্রধান। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সরকারী চাকরীর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোটা তুলে দিয়ে জারী করা পরিপত্র গত ৫ জুন হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করার পর সেই পরিপত্র ফিরিয়ে আনার দাবীতে, অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার দাবীতে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। ১ জুলাই থেকে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার বাদ দিয়ে প্রতিদিনই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেয়া হবে না: ছাত্রলীগ
চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রলীগ কাউকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। গতকাল শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় সরকারী চাকরীতে ‘কোটা’ ইস্যু নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা সংগ্রহ, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংবলিত লিফলেট বিতরণ, উন্মুক্ত আলাপন, যৌক্তিক উপায় নেয়া এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করার জন্য ‘পলিসি অ্যাডভোকেসি ও ‘ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইনের ওপর আলোকপাতের উদ্দেশ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
ইনান বলেন, আমরা একটি ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ নিয়েছি, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর হলে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের সঠিক বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব। কোটা ইস্যুর যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে ঘোলা পানিতে কেউ যেন মাছ শীকার করতে না পারে সেজন্য সচেষ্ট রয়েছি। বিভিন্ন সঠিক তথ্য-উপাত্ত লিফলেট আকারে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরব। কারণ তারা যেন ভুল পথে পা না বাড়ান, কোনো ষড়যন্ত্রে নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবন বিনষ্ট না করেন। এ দেশ আমাদের, শিক্ষার্থীদের বিষয়টি মাথায় রেখে চলতে হবে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের যে দায়বদ্ধতা সেটি যেন তারা পালন করেন।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে ভর করে ষড়যন্ত্র করে এ দেশের অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে সেই ধরনের লোকদের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ততা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কেউ দেশের শান্ত পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে ফল ভালো হবে না।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ