ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

রপ্তানি আয়ের হিসাবে হ য ব র ল

প্রকাশনার সময়: ১৩ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪৩

রপ্তানি আয় নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যে তথ্য দিয়েছে, তার পুরোপুরি উল্টো তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি ২ শতাংশ বেড়েছে—এমন তথ্য দিয়েছিল ইপিবি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এই সময়ে পণ্য রপ্তানী কমেছে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ রপ্তানী আয় নিয়ে সংস্থা দুইটির হিসাবে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এদিকে রপ্তানীর হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। রপ্তানীকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে, ইপিবির রপ্তানী আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের (জুলাই-মে) রপ্তানীর ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে পণ্য রপ্তানী থেকে ৪ হাজার ৭২ কোটি ৯০ লাখ (৪০.৭৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বিভিন্ন খাতের রপ্তানীকারকরা। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ কম।

অথচ ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোনো হিসাবে রপ্তানীর যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, তাতে গেল অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পণ্য রপ্তানী থেকে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ২৭ লাখ (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার আয়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। তাতে ওই ১১ মাসে ২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, রপ্তানীর ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রপ্তানী আয় ১ হাজার ৮১ কোটি ৩৭ লাখ (১০.৮১ বিলিয়ন) ডলার কমে গেছে।

পুরোনো হিসাবে আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) এই ১১ মাসে ৫ হাজার ৫২ কোটি ৭২ লাখ (৫০.৫২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানী হয়েছিল। সংশোধিত হিসাবে তা ৭ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার কমে ৪২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। সংশোধিত হিসাবে বিশাল অঙ্কের এই রপ্তানী আয় কমে যাওয়ায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারও কমে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এর আগেই নতুন হিসাবে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ওলোটপালট হয়ে যাওয়ার তথ্য দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ আগের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাব ছিল উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩ জুলাই বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানীর ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করে। সেখানে ইপিবির প্রকাশ করা তথ্যের সঙ্গে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ফারাক পাওয়া যায়। এর পর থেকে রপ্তানীর তথ্যের গরমিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রপ্তানী আয়ের হিসাবে ব্যাপক গরমিলের ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ওপর দায় চাপিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ৪ জুলাই অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লেখা চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ডলার-সংকটের কারণে দেশের লেনদেন ভারসাম্য বড় চাপে পড়ে। দীর্ঘদিন পর লেনদেন ভারসাম্যের আর্থিক হিসাব ঘাটতিতে পড়ে যায়। এই ঘাটতি তৈরি হয় রপ্তানী যে পরিমাণ হচ্ছে, সেই পরিমাণ আয় দেশে না আসায় এবং আমদানি বিল যে পরিমাণে পরিশোধ হচ্ছে, সেই পরিমাণ পণ্য দেশে না আসায়। এই ঘাটতি বড় হতে থাকায় প্রকৃত অবস্থা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও ইপিবি মিলে কমিটি গঠন করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানী তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করা হয়।

এক সভায় এনবিআরের প্রতিনিধি সরবরাহকৃত রপ্তানীর ডেটাসেটে একাধিকবার রপ্তানীর হিসাব থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানী আয়ের তথ্য-উপাত্ত তফসিলি ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে সংগ্রহ করে থাকে। ফলে সেই তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে প্রকৃত রপ্তানীর তেমন পার্থক্য থাকে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংগ্রহ ও ইপিবি প্রকাশিত রপ্তানীসংক্রান্ত তথ্যে পার্থক্য থাকার কারণগুলো চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, একই রপ্তানী তথ্য এবং পণ্যের এইচএস কোড একাধিকবার ইনপুট দেয়া হয়েছে। পণ্যের কাটিং, মেকিং এবং ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু তৈরির মাশুল হিসাব হওয়ার কথা। কিন্তু ইপিবি কাপড়সহ সব যন্ত্রাংশের হিসাব করেছে। ইপিবি অনেক সময় নমুনা পণ্যের দামও ইনপুট দিয়েছে। অথচ নমুনা পণ্যের কোনো দাম হিসাবে আসার কথা নয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) থেকে দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়কে রপ্তানী হিসাবে এবং এসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানীর সময়ও হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত পণ্য রপ্তানীর সময় রপ্তানীর প্রাথমিক ঋণপত্র (এলসি) মূল্য থেকে কিছুটা কম হয়ে থাকে, যা ইপিবি সমন্বয় করে না। এ ছাড়া স্টকলট, ডিসকাউন্ট এবং কমিশনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ইপিবির হিসাবে সমন্বয় হয় না।

ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংক, ইপিবি, এনবিআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি ব্যয়, রপ্তানী আয়, অদৃশ্য ব্যয়, অদৃশ্য আয়, রেমিট্যান্সের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে লেনদেন ভারসাম্যের বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে। সামপ্রতিককালে রপ্তানীর বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসা কমে যাওয়ায় ট্রেড ক্রেডিট উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূলত রপ্তানী (শিপমেন্ট) ও প্রকৃত রপ্তানী আয়ের ব্যবধানের কারণে হয়ে থাকে।

চিঠিতে বলা হয়, আর্থিক হিসাবে প্রকৃত ট্রেড ক্রেডিট বলতে রপ্তানী (শিপমেন্ট) ও রপ্তানী আয়ের পার্থক্য এবং আমদানি (শিপমেন্ট) ও আমদানি ব্যয়ের পার্থক্যের যোগফল বোঝানো হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সংশোধিত ডেটাসেট ব্যবহার করার কারণে লেনদেনের ভারসাম্যের বিবরণীতে ট্রেড ক্রেডিটসহ চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাব সংশোধিত হয়েছে। তবে এর জন্য সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ, চলতি হিসাবে থাকা উদ্বৃত্ত সংশোধিত হয়ে আর্থিক হিসাবে সমন্বয় হয়েছে।

৩০ জুন শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের ১২ দিন চলে গেছে। তবে বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনের পণ্য রপ্তানীর তথ্য প্রকাশ করেনি ইপিবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জুন মাসের রপ্তানীর কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এত দিন ইপিবির সরবরাহ করা তথ্য গ্রহণ করত।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইপিবি প্রতি মাসের রপ্তানী তথ্য প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত চলমান মাসের ১ থেকে ৩ তারিখের মধ্যে আগের মাসের রপ্তানী তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি। কোনো কোনো মাসে ১ তারিখেও আগের মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে ইপিবি। কিন্তু জুলাই মাসের ১২ দিন পার হয়ে গেলেও জুন মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কবে প্রকাশ করা হবে তাও নিশ্চিত করতে পারছেন না সংস্থাটির কোনো কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইপিবির এক কর্মকর্তা বলেন, রপ্তানী তথ্যের গরমিল ধরা পড়ায় ইপিবি তথ্য বাছাই করছে। এজন্য এ মাসে একটু দেরি হচ্ছে। রপ্তানী তথ্যে অসংগতির যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে, তা সবই ঠিক আছে। আমাদের দেশ থেকে দুইভাবে পণ্য রপ্তানী হয়। এর একটি হচ্ছে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি (ঋণপত্র)। প্রথমে কাপড় ও সুতা আমদানি করা হয়, তারপর রপ্তানী করা হয়। এখানে মোট মূল্য এক্সপোর্ট হিসেবে ধরা হয়। আবার কাপড় ও সুতা বিনামূল্যে ক্রেতারা (বায়ার) পাঠিয়ে দেয়। ওই পণ্য যখন রপ্তানী হয়, তখন ক্রেতারা আমাদের শুধু সিএমটি (কাটিং, মেকিং অ্যান্ড ট্রিমিং) পেমেন্ট করে।

তিনি বলেন, আমরা (ইপিবি) এতদিন পুরো রপ্তানী মূল্য দেখিয়েছি। আর এনবিআর বায়াররা যে কাপড় ও সুতা পাঠান- তা বাদ দিয়ে রপ্তানীর হিসাব করে। সে কারণেই ইপিবি ও এনবিআরের হিসাবে বড় গরমিল হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গত ৩ জুলাই বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের তথ্য নতুনভাবে প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এতে ওলোটপালট হয়ে গেছে হিসাব। দেশের রপ্তানী আয়ের প্রধান খাত নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানীর যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত তথ্য। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানী দেখিয়ে আসছিল ইপিবি। দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়টি আমরা বলে আসছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবই যৌক্তিক। সঠিক হিসাব না দেয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ