কোটাবিরোধী আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শাহবাগ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনটি এখন বেগবান হচ্ছে প্রতিটি জেলায়। কোটাবিরোধী আন্দোলনটি মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে কেন্দ্র করে। সরকারী চাকরীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র, নাতী এবং পরবর্তী বংশধরদের জন্য। এ বিষয়টি দেশের ছাত্রসমাজ মানতে নারাজ তাই তারা আন্দোলনে নেমেছে। মুক্তিযোদ্ধা মানে দেশের সূর্য সন্তান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ করেছিল বলেই বাংলাদেশ হাজার বছরের পরাধীনতার শেকল ছিড়ে স্বাধীনতা লাভ করতে পেরেছে। ছাত্ররাও মহান মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে অস্বীকার করে না। তারাও সম্মান জানায় জাতির সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের। তবে তারাও চায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আরো রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হোক। তবে সব চাকরী ক্ষেত্রে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সংরক্ষিত থাকুক এ বিষয়টা মানতে চাচ্ছে না ছাত্রসমাজ। কোটাভিত্তিক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে আইনী লড়াই চলছে আদালতে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নিম্ন আদালতের দেয়া রায়কে বহাল রেখেছে। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য বহাল রাখা বিধানটিতে আদালত ‘হ্যাঁ’ সূচক রায় দিয়েছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে। তাই সরকার এ বিষয়ে কোনো কিছু বলছেন না। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় দেয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল। ওই রায় বাতিলের দাবীতে ছাত্রসহ দেশের সব শ্রেণীর মানুষ আন্দোলনে নামে, গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ।
সারা দেশে উত্তাল হয়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনকারী ও ত্রিশ লাখ শহীদকে হত্যা করা এদেশীয় দোসরদের বিচার সংক্রান্ত আইনটি সংশোধিত করা ছিল গণজাগরণ মঞ্চের দাবী। জনগণের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংসদে আইনটি সংশোধিত হয়। কোটা সংক্রান্ত আইন ও রাজাকার, আলবদর, আলসামস এর বিচার সংক্রান্ত আইনটিকে এক করে ফেলাটা ঠিক হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমের ওপর হামলকারীদের বিচার সংক্রান্ত আইনী বিষয়। আর বর্তমানে যে কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছে, তা হচ্ছে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যে মুক্তিযোদ্ধারা এনেছে তাদের সুযোগ সুবিধা সীমিত করার লক্ষে আইনী সংশোধন। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্পষ্ট কিছু বক্তব্য আসা দরকার। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ মাতৃকা মুক্ত করার লক্ষ্যেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের প্রাপ্তির লক্ষ্যটা ছিল বাঙালিদের স্বাধীনতা। জীবন সায়াহ্নে দেশের সব মুক্তিযোদ্ধা তাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বিষয়ে বক্তব্যটা কি তা জানা দরকার দেশবাসীর। দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, বিভিন্ন সরকারের আমলে প্রস্তুত করা মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাগত পার্থক্য রয়েছে। ১৯৮৪ সালের প্রস্তুত করা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন। এ তালিকা প্রস্তুত করতে সাহায্য নেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কলোনি ট্রাস্টের, চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত তালিকার সমন্বয়ে।
বিএনপির সরকারের আমলে (জামায়াত সমন্বয়ে গঠিত চারদলীয় জোট সরকার) মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৪৮১ জন। এ তালিকা থেকে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। বেশ কিছু দিন আগে দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায়, ১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন, ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের প্রস্তুতকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সংখ্যা ছিল ৬৯৮৩৩ জন, ১৯৯৪ সালে এর সংখ্যা হয় ৮৬০০০, ২০০১ সালে দুইটি সংখ্যা পাওয়া যায় তা হলো- ১ লাখ ৮৬ হাজার ১৯০ জন, আরেকটি ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের, ২০০৬ সালে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের, ২০১৬ সালে গণমাধ্যম থেকে পাওয়া যে সংখ্যাটি উল্লেখ করা হলো তা ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার।
মুক্তিযোদ্ধার এ সংখ্যাগত তারতম্য নিয়ে নানা অভিযোগ এবং রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও বিষয়টি নিয়ে আইন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাসহ সম্মানী ও নানা সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে যে দলটি দেশ পরিচালনা করছেন এ দলটিই মুক্তিযুদ্ধটা পরিচালনা করেন। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য রোধকল্পে আইনও তৈরী করেছেন। বাংলাদেশের মোট পরিবারের সংখ্যা ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার অর্থাৎ প্রায় চার কোটি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ বা তার কিছু বেশী। মোট পরিবারের মধ্যে দশমিক ৬২৫ শতাংশ হলো মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। হিসাবে দেখা যায়, সারা দেশের মোট পরিবারের এক শতাংশেরও কম। তাই ৩০ শতাংশ কোটার বিষয়টি অনেক বেশী হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ কোটা দেয়ার বিষয়টি অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনায় নেয়াটা ঠিক হবে না। বীর মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে জীবন বাজী রেখে যে বীরত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন সেই বীরের সম্মানসূচক পুরস্কার হলো মুক্তিযোদ্ধা কোটা। দেশের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা রাখতে পারলে বিষয়টি সবার জন্য মনে হয় ভালো হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক চাকরীর বেলায় দেখা যায় ৩০ শতাংশ কোটার বিপরীতে ওই পরিমাণ আবেদন পড়ে না। সুতরাং এ জায়গাটা বিবেচনায় নিলে মনে হয় বীর মুক্তিযোদ্ধারাও সংক্ষুব্ধ হবেন না।
দেশের চলমান আন্দোলনটা বিএনপির ইন্ধনে হচ্ছে এমন কথা বলা ঠিক না। আন্দোলনকারীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মানপূর্বক আন্দোলন কর্মসূচি দিচ্ছেন। এখানে আরেকটি বিষয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেনশন স্কিম বিরোধী আন্দোলন করছে। এ দুই আন্দোলনকেও একভাবে দেখা উচিৎ না। শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে তা একটি মৌলিক বিষয় নিয়ে। যে বিষয়টিতে নির্ধারিত হবে আগামীর রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর মেধা। কারণ বর্তমানে দেশে দক্ষ সৎ ও মেধাবী সরকারী কর্মীর অভাব। সারা দেশ ছেয়ে গেছে দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীতে। মেধা যাচাই করে নিয়োগ দিতে হলে কোটা প্রথাটা বিচেচনায় না নেয়াটাই শ্রেয় কাজ হবে। কারণ জেলা কোটা, পোষ্য কোটা, তফশীলি জনগোষ্ঠী কোটার থাকলে মেধাবী প্রার্থীরা নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়। মেধাবী কর্মীর অভাবে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। দেশের আমলাদের অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলো লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের লাভের জন্য ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সব শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ৭২-৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় শিল্প কলকারখানাগুলো লাভজনক ছিল।
অথচ ওই সময়টা ছিল বাংলাদেশ একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্র। এত প্রতিকূল অবস্থায় জাতির জনক সরকারী শিল্প কারখানাগুলো লাভজনকভাবে পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের পট পরির্বতনের পর অদক্ষ ও অযোগ্য সরকারী কর্মীর তত্ত্বাবধানের এ শিল্প কারখানাগুলো পরিচালিত হয়। তাই এ কারখানাগুলো লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে থাকে। এখন এ শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই মেধাবী ও অদক্ষ জনবল নিয়োগের জন্য কোটার বিষয়টি একটু ভাবা দরকার। কারণ যে হারে দুর্নীতি বাড়ছে তা নিরোধ করতে না পারলে দেশের অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেবে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ