এটা সর্বজন বিদিত যে গ্রিক শব্দ ‘পলিটিকোস’ থেকে ইংরেজি ‘পলিটিক্স’ এবং বাংলায় ‘রাজনীতি’ শব্দটির উৎপত্তি। ‘রাজনীতি’ শব্দটির মূল অর্থ হলো প্রজাদের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম-নীতি, যা ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশনায়ক রাজনীতিবিদগণ গ্রহণ করে থাকেন। রাষ্ট্রের মূলনীতি অনুযায়ী রাজনীতি মূলত নগর ও সমাজ পরিচালনার এক অহিংস পদ্ধতি। নীতি বহির্ভূত কোনো কাজকে কখনো রাজনীতি বলে না। রাজনীতি একটি মহৎ কাজ।
আবেগ এখানে মূল্যহীন। প্রাচীন গ্রিসে রাজনীতি বলতে নগর রাষ্ট্র ও তার শাসন ব্যবস্থার বস্তুগত ও দর্শনগত অধ্যয়নকে বোঝাত। সাধারণ অর্থে, রাজনীতি বলতে সেসব নীতিমালাকে বলা হয়, যা অনুসরণের মাধ্যমে একটি জাতি বা একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, যাকে বলা হয় দেশের মূল চালিকাশক্তি, যার মাধ্যমে দেশকে নির্মাণ করা যায়। দেশের মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা যায়। রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে যা কোনো দেশ বা দলের রাজনীতিতে প্রতিফলিত হলে তাকে আদর্শ রাজনীতি বলে। আদর্শিক রাজনীতির একটি নির্দিষ্ট পরিধি বা সিলেবাস রয়েছে যা অনুসরণ করেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশেও যতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদের সবারই উচিত রাজনীতির নির্দিষ্ট যে একটা সিলেবাস রয়েছে তার ভিতরে থেকে নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। এতে রাজনীতি করে দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন সম্ভব। কারণ আদর্শিক রাজনীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হলো রাজনীতির মাধ্যমে দেশ ও দশের কল্যাণ নিশ্চিত করা, দেশের স্বার্থকে দল ও দলীয় নেতাকর্মীদের স্বার্থ থেকে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া।
অথচ, রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) রাজনীতির আদর্শিক জায়গা থেকে সরে গিয়ে রাজনীতির নামে রাজনৈতিক সিলেবাস বহির্ভূত অপরাজনীতি করে যাচ্ছে। জনসমর্থনহীন ও জনবিচ্ছিন্ন বিএনপি বর্তমানে রাজনীতির নামে দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অপরাজনীতি করছে। আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বিরোধিতার রাজনীতি করছে। ভারত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করে আসছে। কথায় আছে, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। বাংলাদেশের মহাবিপদ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যখন পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল সেখানে ভারত অন্যতম একটি রাষ্ট্র যারা পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে টেক্কা দিয়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের যে কোনো আদর্শিক রাজনৈতিক দল এবং সচেতন নাগরিক সমাজ মানেই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। অপরদিকে, রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ বহির্ভূত বিএনপির রাজনীতি মানেই অহেতুক ভারত বিরোধিতা যা কোনোভাবেই রাজনৈতিক সিলেবাসের মধ্যে পড়ে না।
যার ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক আয় নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেড়ে যাবে। সমঝোতা স্মারকের এ গুরুত্বপূর্ণ অংশকে আলোচনার পেছনে রেখে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের ট্রেন চলাচলের বিষয়টিকে একচেটিয়াভাবে সামনে নিয়ে এসে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে এ ধরনের অযৌক্তিক দাবী তোলাই প্রমাণ করে বাংলাদেশে সার্বভৌমত্ব খর্ব হবে বিষয়টি এমন নয় বরং বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিএনপি ভারত বিরোধিতার রাজনীতি বেগবান করার অপপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক সত্যিকার অর্থে বিএনপির মতো স্বার্থান্বেষী একশ্রেণীর রাজনৈতিক দল কিংবা বিএনপির নেতাদের মতো একশ্রেণীর লোক সহ্য করতে পারে না। তারা সব কিছুতেই দোষ খোঁজে, দেশ বিক্রীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। কিন্তু তারা সুকৌশলে আসল সত্যটা এড়িয়ে যায়। আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত ২০২২ সালে বাংলাদেশকে ট্রানজিট দিয়েছে। বিনা মাশুলে তাদের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দিয়েছে। এতে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক নেপাল ও ভুটানে সরাসরি যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যার ফলে সেখানে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। অথচ এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিএনপির মতো ভারতের কোনো বিরোধী দল প্রশ্ন তোলেনি, দেশ বিক্রীর অজুহাত দাঁড় করেনি। তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি কেন ট্রানজিট দিলে দেশ বিক্রী হয়ে যাবে তথা দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসবে এ ধরনের অযৌক্তিক দাবী করছে? এ দাবীর পেছনে আসল কারণ খুঁজতে গেলে যা স্পষ্ট তা ট্রানজিট নয় বরং ভারতবিরোধী বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বিএনপি।
সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, ট্রানজিট দিয়ে দেশ ও জনগণের অনেক বেশী লাভ হলেও বিএনপির ক্ষতি। কারণ ভারতবিদ্বেষী বিএনপির কাছে বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক এক ধরনের আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যত বেশী মজবুত হবে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির ভিত তত বেশী নড়বড়ে হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণের সমর্থন হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি এখন ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও অপপ্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিছুদিন পরপর নতুন নতুন ইস্যু তৈরী করে অপপ্রচারের রাজনীতি করা ছাড়া বিএনপির এখন আর তেমন কিছু করার নেই। তবে আপনারা একটা বিষয় জেনে সত্যি অবাক হবেন যে, অল্প কিছু মাস পূর্বে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্য অতীতের ন্যায় ভারতের পেছনে ঘুরেছে। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে দেখা গেছে বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, কিন্তু নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে আবার সমালোচনা মুখর বক্তব্য শুরু করে। এবারো জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর নতুন করে ভারত বিরোধিতায় সোচ্চার হয় বিএনপি। তারা প্রথমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে ইন্ডিয়া বয়কটের প্রচারণা চালায়। যা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বর্জনের ডাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আবার রেল ট্রানজিট ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। তাদের জনসমর্থনহীন এসব চেষ্টা কোনোদিনও সফল হবে না। কেননা, রাজনৈতিকভাবে সফল হতে হলে রাজনৈতিক পরিধি বা সিলেবাসের ভিতর থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয় যা বিএনপি কোনোদিনও পারেনি। প্রয়োজন হলে ভারতের পেছন পেছন ঘোরা আর প্রয়োজনে না আসলে ভারতের চরমভাবে বিরোধিতা করা এগুলো কী আসলেই কোনো রাজনৈতিক সিলেবাসের মধ্যে পড়ে? উত্তর হচ্ছে, কখনোই না। এগুলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিলেবাস বহির্ভূত কর্মকাণ্ড। পৃথিবীতে রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ দলগুলোই কেবল বিএনপির মতো এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার রাজনীতি করে থাকে।
বিএনপির বোঝা উচিৎ যে, রাজনীতির নামে এ ধরনের অপরাজনীতি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা নাগরিক সমাজ এখন আর খায় না। রাজনীতি করতে হবে আদর্শিক জায়গা থেকে। দেশ ও দশের কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রেখে রাজনীতি করা উচিৎ। রাজনীতির নামে আগুন-সন্ত্রাস, দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত, দেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের বিরোধিতা কখনো আদর্শিক রাজনীতি হতে পারে না। এগুলো মূলত রাজনীতির নামে অপরাজনীতি।
এখনো সময় আছে বিএনপির উচিৎ এ ধরনের অপরাজনীতি বন্ধ করে রাজনৈতিক সিলেবাস অনুসরণ করে আদর্শিক রাজনীতির চর্চা করে রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকার চেষ্টা করা। অন্যথায়, ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষিত হলে অচিরেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে বিএনপির নাম, যা আমরা গণতন্ত্রমনা সচেতন নাগরিক সমাজ কখনোই প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই— গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সবগুলো দল অপরাজনীতির চর্চা ত্যাগ করে আদর্শিক রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকুক। এতে টিকে থাকবে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এবং টিকে থাকবে লাখ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ