ঢাকা, রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মতিউরের ক্যাশিয়ারও শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক 

প্রকাশনার সময়: ১১ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৭

ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউরের তথাকথিত ক্যাশিয়ার তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ ছিলেন একজন সাধারণ বীমা কর্মী। শুধু অন্যের টাকা-পয়সার হিসাব রাখার মধ্যেই সীমিত থাকার লোক নন তিনি। তাই তো মতিউরের সঙ্গে সঙ্গে ফুলেফেঁপে উঠেছে তার নিজের অর্থ-সম্পদ।

সূত্র জানায়, তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ কর্মজীবনের বড় সময় পার করেন গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। শুল্ক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সংস্পর্শে এসে বদলে যায় তার জীবন। বাড়তে থাকে সম্পদ ও প্রতিপত্তি। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ফরহাদ ও তার পরিবার এখন প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মী হলেও বড় শিল্পোদ্যোক্তারাও তার প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে ম্লান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ বর্তমানে মতিউরের পারিবারিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসকে ট্রিমসের চেয়ারম্যান। এ কোম্পানিতে তার শেয়ার সংখ্যা ১৬ লাখ ৯৪ হাজার। আর এসকে ট্রিমসের নামে রয়েছে অন্য সাত কোম্পানির প্রায় ২০ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার। সিনার্জি ট্রেডিংয়ে আছে ফরহাদের ৫০ হাজার শেয়ার। এ ছাড়া গ্লোবাল সু কোম্পানিতে ফরহাদ ও তার দুই ছেলের নামে প্রায় ৫০ লাখ শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে তার নিজের নামে আছে ১৬ লাখ ২২ হাজার ৪৫২টি শেয়ার। আর তার ছেলে তাসাদ্দিক হোসেন ফারাবির নামে ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৬৬ এবং মোসাদ্দেক হোসেন রাইবির নামে ১৬ লাখ ২১ হাজার ৮৮২টি শেয়ার রয়েছে। যদিও দুদকের নোটিশের জবাবে ফরহাদ জানিয়েছিলেন, তার সন্তানদের নামে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কোনো সম্পদ নেই।

শুধু কোম্পানির মালিকানা নয়, ইন্স্যুরেন্স কর্মী ফরহাদের রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে আলিশান প্রাসাদ। এ ছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিজ গ্রামে একটি আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন। ওই এলাকায় নামে-বেনামে বিপুল জমিও কিনেছেন। কৌশলী ফরহাদ তার জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা আয়কর রিটার্নের কোথাও গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করেননি। জাতীয় পরিচয়পত্রে ব্যবহার করেছেন গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় ও গুলশানের ঠিকানা। আর আয়কর রিটার্নে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করছেন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ঠিকানা।

জানা যায়, তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ কর অঞ্চল-৪-এর আওতায় একজন টিআইএনধারী। কয়েক বছর ধরে তিনি নির্ধারিত সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না। অন্য কোনো সার্কেলে জমা দেন বলে কর কর্মকর্তাদের ধারণা। যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর ছাড়া অন্য কোথাও রিটার্ন দাখিলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর অঞ্চল-৪-এর একাধিক কর্মকর্তা।

আইডিআরএ সূত্র জানায়, সাধারণ বীমা করপোরেশনের পরিচালক থাকাকালে তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদের বিরুদ্ধে রি-ইন্স্যুরেন্সে ক্লেইম বা দাবি আটকে রেখে অনৈতিকভাবে কমিশন গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। আর পরিচালকের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতেও তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন। মতিউরের সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির ব্যবস্থা করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে ফরহাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে সাধারণ বীমার পদ ব্যবহার করে অবৈধ কমিশন বাণিজ্যে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফরহাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সেই প্রক্রিয়া বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তদন্ত থেমে যায়। মতিউরের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও ওই তদন্ত বন্ধের জন্য তৎপর ছিলেন।

তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘ফরহাদ সাহেব খুবই চালাক প্রকৃতির লোক। উনার তদন্ত শুরু হওয়ার পরই চাপ আসতে থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও বড় ধরনের চাপ এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রভাবশালী এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জন্য তাকে অব্যাহতি দিতে হয়েছে। আসলে অনেক সময় অনেক কিছু করার থাকে না। ফরহাদের চাকরি ও তার লাইফস্টাইলে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আর তার সম্পত্তিতে বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।’

জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ফরহাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল। তদন্তে তার নামে গ্রিন ডেলটা সিকিউরিটিজ, মসিউর সিকিউরিটিজ, আইসল্যান্ড সিকিউরিটিজ এবং লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজে ছয়টি বিও অ্যাকাউন্টের তথ্য পায় দুদক। এসব বিওএর মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলেও সেই তদন্ত বেশিদূর অগ্রসর হয়নি।

এ বিষয়ে তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ বলেন, মতিউর রহমানের সঙ্গে আমার শুধু শেয়ার-সংক্রান্ত্র ইস্যুতে লেনদেন হয়েছে। এক টাকার নগদ লেনদেন হয়নি। আইডিআরএর তদন্তে চাপ প্রয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বীমা কর্মী; দীর্ঘদিন বীমায় চাকরি করেছি। আমি কীভাবে প্রভাব বিস্তার করব? আর অর্থ বিভাগের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তিনি চেনেন না বলেও দাবি করেন। এছাড়া দুদকের তদন্তের বিপরীতে আপনি বলেছেন, আপনার ছেলেদের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোনো সম্পদ নেই। আপনার ছেলেদের নামে গ্লোবাল সু কোম্পানিতে প্রায় ৪০ লাখ শেয়ার রয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ বলেন, এটা দুই বছর আগে নিয়েছি। নির্ধারিত কর সার্কেলে কর দিয়ে আসছি। আর সব সম্পদের কথা কর ফাইলে উল্লেখ রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ