ঢাকা, রবিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬

কোটা আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা অপ্রত্যাশিত

প্রকাশনার সময়: ১১ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪০

গতকালের তাজা খবর হচ্ছে, সরকারী চাকরীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে কোটা পুনর্বহালের যে রায় হাইকোর্ট দিয়েছিল তার ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তারা কোনো ঝুলন্ত সিদ্ধান্ত মানবেন না।

এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায় প্রকাশিত হলে সেটার ওপর শুনানি হলে তখন এ বিষয়ে চূড়ান্ত আদেশ দেয়া হবে বলে জানান আইনজীবীরা। এবং হাইকোর্টের রায়ের ওপর পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।

এখন ছাত্রছাত্রীরা কি করবে? বাংলা ব্লকেড নামের যে বাংলা বন্ধ তার ডালপালা অনেকদূর ছড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাস ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। যে কোনো ভাবেই হোক না কেন এ আন্দোলনের নেতিবাচক প্রভাব এখন ছড়িয়ে পড়েছে। কেন এ আন্দোলন?

কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত পহেলা জুলাই থেকে যে আন্দোলনে নেমেছে সেখানে চারটি সুর্নিদিষ্ট দাবী জানানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের দাবীগুলো হলো— প্রথমত, ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারী চাকরীতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা।

দ্বিতীয় দাবী হচ্ছে, পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠনপূর্বক দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারী চাকরীর সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেয়া (সুবিধা বঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী ছাড়া)। তৃতীয়ত, সরকারী চাকরীর নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া।

তাদের সর্বশেষ দাবী হচ্ছে, ‘দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র’ নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আপাত দৃষ্টিতে তাদের চাওয়াগুলো নিয়ে তেমন কিছু বলা যাবে না। মনে হবে সবগুলো চাওয়াই যৌক্তিক। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করলেও গত পাঁচই জুন ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ পুনর্বহালের রায় দেয় আদালত।

এরপরই কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় আন্দোলন। কিন্তু এ কোটা আসলে কী? এটি কাদের, কী বিবেচনায় দেয়া হয়? বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থার চালু কবে থেকে?

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা। এখন বিষয়টি মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ মুখোমুখি অবস্থান মূলত সরকার বনাম ছাত্র ছাত্রীরা। যেসব ছাত্রছাত্রী রাস্তায় আন্দোলন করছে তাদের বয়স চেহারা আর কথাবার্তা’র দিকে তাকালেই বোঝা যায় তারা মূলত নীরিহ। তাদের মনের চাওয়া একটি ভালো চাকরী। প্রাইভেট খাত থাকায় বহু যুবক যুবতীর চাকরী হলেও সরকারী চাকরীর মূল্য অনেক বেশী। সত্যি কথা বলতে কি দেশে সরকারী চাকারী মানে এখন আলাদীনের চেরাগ। আমাদের যৌবনে সরকারী চাকরী মানেই করণিকের কাজ। সমাজে এসব চাকরীকে মূল্যবান মনে করা হতো না। তার চেয়ে পছন্দের চাকরী ছিল সদ্য গজানো প্রাইভেট খাত। ঝকঝকে পোশাক স্যুট টাই পরিহিত তরুণ বা আধুনিক সাজে সজ্জিতা তরুণীরা ছিল সমাজের ক্রিম। প্রাইভেট ব্যাংক ইনস্যুরেন্স বা করপোরেট নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সোনার হরিণ। কিন্তু কালক্রমে দুটো বিষয় পরিষ্কার হতে দেরী হলো না। প্রথমত, এসব চাকরী মানেই খাটুনী। টার্গেট বা গোল বাস্তবায়নের নামে অস্বাভাবিক চাপ। এরপর আছে অনিশ্চয়তা।

অন্যদিকে সরকারী চাকরী মানেই পায়ের ওপর পা তুলে জীবন কাটিয়ে দেয়া। কম পরিশ্রমে এখন ভালো বেতন মানেই সরকারী চাকরী। তা ছাড়া দেশের সেবা বা সমাজের উপকারে লাগতে হলে সরকারী চাকরীর বিকল্প নাই। কিন্তু কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আন্দোলন কি আসলেই চাকরী পাবার আন্দোলন? আমরা সবাই জানি কোটাবিরোধী আন্দোলন মূল লক্ষ্য হলো মুক্তিযুদ্ধ। আপত্তিটাও সেখানেই। বিশ্বের আরো অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কোটা আছে। সেটা শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। বঙ্গবন্ধুর আমলে কোটা ছিল, জিয়ার আমলে ছিল, এরশাদের আমলে ছিল, খালেদা জিয়ার আমলে ছিল। আগে কিন্তু কোনো আন্দোলন হয়নি। কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। টাইমিংটা খেয়াল করুন। ২০১৩ সালে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভিন্ন কৌশল নেয়। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঞ্চনার ক্ষোভ সঞ্চারিত করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চাকরী নিয়ে নিচ্ছে, এ সরল হিসাবে তাদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। তারপর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণজাগরণের পাল্টা হিসেবে কোটাবিরোধী গণজাগরণ সৃষ্টি করে।

সাংবাদিক প্রভাষ আমিনের লেখা থেকে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না: ‘১৮ কোটি মানুষের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরী পেতে চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র সবার পাশেই দাঁড়াবে। আদিবাসীরা চাকরী পাবে না, নারীরা চাকরী পাবে না, প্রতিবন্ধীরা চাকরী পাবে না, মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিরা চাকরী পাবে না; সব চাকরী আমাদের দিতে হবে; এ ভাবনাটাই স্বার্থপর। কোটাবিরোধী চলমান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়া। মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবনের মায়া না করে দেশের জন্য লড়েছেন, শহীদ হয়েছেন। যখন যুদ্ধ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই তারা ভাবেননি, তাদের সন্তানরা কোটায় চাকরী পাবে। তারা ভাবেননি বলে আমরাও ভাবব না? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তাদের রক্তে আজকে আমরা স্বাধীন দেশে বসে কোটার বিপক্ষে আন্দোলন করতে পারছি।

আমাদের জন্ম পূর্ব পাকিস্তানে। আমরা পরাধীনতা দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে বস বা কর্তারা আসতেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। কী তাদের যোগ্যতা বা কি তাদের লেখাপড়া সেটা বড় কথা না। তারা শাসকের কোটায় পূর্ব বাংলা শাসন করতেন। এসব নতুন প্রজন্মের বাচ্চারা জানে না আমাদের একজন খেলোয়াড়কেও পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমে জায়গা দেয়া হতো না। মাঠে পানি বহন বা গামছা এগিয়ে দেয়াই ছিল বাঙালির কাজ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বা তার সহযোগী তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলামেরা এমনি এমনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। আমাদের দুর্ভাগ্য কখনোই আমাদের ছেড়ে যেত না। সামরিক বাহিনী থেকে পুলিশ বা সরকারী দপ্তরে ন্যূনতম মজুরীর কোটায় চাকরী করতে হতো বাঙালিকে। সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের নামই ছিল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদা আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

একবার ভাবতে হবে যেসব লুঙ্গি পরিহিত খালি পায়ে বন্দুক হাতের যোদ্ধারা লড়াই করতেন তাদের কথায়। তারা তো অস্ত্রও পেতেন না ঠিক মতো। জানের ভয় হাতের মুঠোয় নিয়ে এরা পাক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করত। সেই পাক বাহিনী সারা দুনিয়া যাকে জানত ত্রাস হিসেবে।

কোটায় তাদের সন্তান বা নাতি পুতিরা চাকরী পাবে সে আশায় কেউ যুদ্ধে যায়নি। এসব বাচ্চাদের কেউ ইতিহাস জানায় না। উল্টো প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এদের কোমল মনে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে কারণে তাদের স্লোগান শুনে ব্যানারের লেখা পড়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আমাদের গর্ব। তার মতো মানুষকেও বিচলিত হতে হয় এসব কর্মকাণ্ডে।

স্বাধীনতা বিরোধী আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা হালে পানি পাচ্ছে না। ছলে বলে কৌশলে তাদের এমন একটা শক্তি বা অজুহাত দরকার। কোটাবিরোধী আন্দোলন ও রাজাকার তোষণ এক হয়ে গেলে দেশ ও সমাজের অস্তিত্ব থাকবে না। রাজনীতি বিশেষত সুবিধা ও ভোগের রাজনীতির উচিত ড্রইং রুম থেকে বের হয়ে এসে শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করা স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা। তাদের এটা বোঝাতে হবে দেশ, স্বাধীনতা আর দেশের ইতিহাসকে মনে রেখেই কোটা অকোটা। তার বাইরে কোনো ঘটনা মানেই উত্তেজনা তৈরী করা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে সমাধানের জন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ একটি তালিকা দরকার ছিল। যেটি একেবারেই নির্ভুল। কারো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকত না। স্বাধীনতার এত বছর পরও এমন একটি তালিকা না থাকা সত্যি দুঃখজনক। এ কাজটি আরো আগে করা হলে কোটা আন্দোলনকারীদের বোঝানোও সহজতর হতো। ন্যায্যতা পেত সব যুক্তি। সুমতি ফিরুক সংশ্লিষ্ট সবার। কোটা আন্দোলনের মূল চেহারা ও সমাধান ঠিক হোক এটাই কামনা।

লেখক: সিডনি প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ