ঢাকা, রবিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬

কোটা নিয়ে ‘স্থিতাবস্থা’

প্রকাশনার সময়: ১১ জুলাই ২০২৪, ০৮:৩৪

সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেয়া রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারী করেছেন আপীল বিভাগ। পৃথক দুটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপীল বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ স্থিতাবস্থা জারী করেন। কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, কোটা নিয়ে এখন কোনো কথা বলা যাবে না। হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আপীল বিভাগ আবার বিষয়টি শুনবে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানী হবে আগামী ৭ অগাস্ট। এ সময় প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানান। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা সংস্কারের বিষয়ে কোর্ট নয়, নির্বাহী বিভাগের কাছে সিদ্ধান্ত চান তারা। রাাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে তারা বলছেন, যতক্ষণ কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার না আসবে ততক্ষণ তারা রাজপথে থাকবেন। আজ বৃহস্পতিবারও বিকেল ৩টা থেকে সারা দেশে বাংলা ‘ব্লকেডে’র ডাক দেয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শাহাবাগ মোড় থেকে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

জানা গেছে, গতকাল প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ থেকে সরকারী চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেয়া হয়। আপীল বিভাগের এ আদেশের ফলে আপাতত কোটা থাকছে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী। একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। তবে তিনি বলেছেন, আন্দোলনকারীদের দাবী মানার ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় আছে। আসলে আদালতের এ স্থিতাবস্থার পর কী দাঁড়াল? কোটা আছে নাকি নেই? এ আদেশের মানে কী, তা জানতে চাইলে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, মানে হলো, যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থাকবে। হাই কোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে।

নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত চান আন্দোলনকারীরা: হাই কোর্টের দেয়া রায়ে আপীল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারীর পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আপনারা (সাংবাদিক) অপেক্ষা করুন। আমরা বিস্তারিত জানাব। আদালতে কী হয়েছে এখনো বিস্তারিত জানি না। তবে এতটুকু বলতে চাই, কোটা সংস্কারের বিষয়ে কোর্টের কাছে নয়, নির্বাহী বিভাগের কাছে সিদ্ধান্ত চাই।’

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারীতে আশাহত হয়েছেন জানিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এ রায়ে আমরা আশাহত হয়েছি। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে চার সপ্তাহের রায় দিত না। এটা সারা দেশে চলমান আন্দোলনকে দমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের অংশ। কিন্তু আমরা দেখছি তারা সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছেন। বাঙালিকে হাই কোর্ট দেখানোর মতো করে এ রায় দেয়া হয়েছে।’ দাবী নির্বাহী বিভাগের কাছে জানিয়ে হাসনাত বলেন, ‘আমাদের এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে হাই কোর্ট এনে আমাদের শত্রু বানাবেন না। আমাদের দাবী নির্বাহী বিভাগের কাছে। নির্বাহী বিভাগ চাইলেই সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করে বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে দিতে পারে। সংসদে আইন পাস করতে পারে। তারা চাইলে আমাদের রাজপথ থেকে পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নিতে পারে।’

আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা: সর্বোচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা জারী করলেও সংসদে আইন পাস করে সরকারী চাকরীর কোটা ব্যবস্থার ‘যৌক্তিক’ সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরী প্রত্যাশীরা। তাদের দাবী, শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে সরকরী চাকরীর সব গ্রেডে সব ধরনের কোটা বাতিল করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের স্থিতাবস্থা জারীর আদেশের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার দুপুরে শাহবাগ মোড়ে অবরোধ কর্মসূচি থেকে এ ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এ আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘আমরা কি কয়েকদিন পর রাস্তায় নামব? আমরা ঝুলন্ত সিদ্ধান্ত মানি না। হাই কোর্টের রায়ে আমরা আশাহত। আমাদের আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়ার জন্য এ রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা দমে যাইনি। কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আমাদের দাবী হাই কোর্টের কাছে নয়। আমাদের এক দফা দাবী নির্বাহী বিভাগের কাছে। সংসদে আইন পাস করে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে।’

এদিকে গতকাল সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। সরকারী চাকরীতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারী করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সারা দেশেই এ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। ফলে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে।

কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবীতে টানা কয়েকদিন ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। বড় বড় পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নিয়ে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচির কারণে ভোগান্তি এড়াতে রাস্তায় মানুষ ও যানচলাচল ছিল তুলনামূলক অনেক কম। বুধবার সকাল থেকে দিনভর অধিকাংশ সড়ক খালি দেখা গেছে। এছাড়া ছিল না পর্যাপ্ত বাস। সড়কে যানজটও তেমন একটা ছিল না। তবুও জরুরী কাজে ঘর থেকে বেরিয়ে সড়কে ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। কারণ মোড়ে মোড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাস্তা ব্লক করে অবস্থান করার কারণে যানচলাচল অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। জরুরী সেবা, অ্যাম্বুলেন্স, স্কুল ফেরত শিক্ষার্থীদের গাড়ি এবং ওষুধ ও খাদ্য পণ্য বহনকারী যানবাহন ছাড়া কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া হয়নি।

গতকাল বুধবার দিনভর বাংলা ব্লকেড পালনে আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, উড়োজাহাজ ক্রসিং, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, মৎস্য ভবন, কাকরাইল মোড়, নাইটিঙ্গেল মোড়, ফার্মগেট, চানখারপুল মোড়, বঙ্গবাজার, শিক্ষা চত্বর, জিপিও, গুলিস্তান, সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত, রামপুরা ব্রিজ, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, হাতিরঝিল মোড়, আগারগাঁও, বিজয় সরণি ও মহাখালী এলাকায় সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফ্লাইওভার ও মগবাজার-সাতরাস্তা ফ্লাইওভারও ব্লক করে দেন আন্দোলনকারীরা। এছাড়া মহাখালী ও কারওয়ানবাজার রেল ক্রসিংয়ে কাঠের গুঁড়ি ফেলে রেলপথ ব্লকড করেছেন তারা। এতে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

রাবি-রুয়েট শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ : সরকারী চাকরীতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবীতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বিক্ষোভে যোগ দেন। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অবস্থান নেন। পরে সেখান থেকে রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করে বিকাল ৪টা পর্যন্ত আন্দোলন করেন। এ সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে। এর আগে, বেলা ১১টার দিকে সব হল থেকে প্যারিস রোডে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে এক বিশাল মিছিল নিয়ে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এ সময় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সব যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।

রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ: ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর আপীল বিভাগের স্থিতাবস্থা প্রত্যাখ্যান করে সমাধান না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পরে তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়ক অবরোধ করে রাখেন।

চবি শিক্ষার্থীদের রেল ও সড়ক অবরোধ: কোটা পদ্ধতি সংস্কার করার এক দফা দাবীতে রেলপথ অবরোধের পাশাপাশি আদালতের স্থিতাবস্থা প্রত্যাখ্যান করে সড়কপথ অবরোধ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে সড়কের চারপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বুধবার বেলা ১টার দিকে চট্টগ্রামের টাইগারপাস অবরোধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এর আগে সকাল পৌনে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে চড়ে ১৭ কিলোমিটার দূরে দেওয়ান হাটে আসেন শিক্ষার্থীরা। তারপর দেওয়ান হাট রেলপথ অবরোধ করেন। এর পাশাপাশি চট্টগ্রামের ব্যস্ততম সড়ক টাইগারপাস অবরোধ করেন তারা।

বাকৃবিতে রেলপথ অবরোধ : একই দাবীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা রেলপথ অবরোধ করেন। গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা থেকে দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা ট্রেনটি অবরোধ করেন তারা। এর ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া কোটা ইস্যুতে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর আপীল বিভাগের স্থিতাবস্থা প্রত্যাখ্যান করেছেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা।

জাবি শিক্ষার্থীদের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ: প্রায় একই সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কের উভয় লেনে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক (ডেইরি গেট) সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ