‘দালালদের দৌরাত্ম্যে’ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনদের চিকিৎসা পেতে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবায় কুমিল্লাসহ আশপাশের জেলাগুলোর ‘প্রধান বাতিঘর’ খ্যাত এ হাসপাতাল থেকে বছরের পর বছর সুচিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের।
রোগী ও তাদের স্বজনদের ভাষ্য, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরও এ হাসপাতালে সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। এর মধ্যে হাসপাতালজুড়ে দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ— হাসপাতালজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ এবং ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডে দালালদের প্রভাব বেশী। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারেও (ওটি) কাজ করেন দালালরা। জরুরী বিভাগ এবং ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ড থেকে রোগীদের কৌশলে প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামেও কাটা হচ্ছে রোগীদের পকেট। তবে হাসপাতালের পরিচালকের ভাষ্য, অতীতের চেয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে দালালদের ধরা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সময়ই ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডের ওটিতে রোগীর কাটাছেঁড়া থেকে সেলাই পর্যন্ত দালালরা করেন। এ ছাড়া রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকের সিল-স্বাক্ষর ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ লেখেন দালালরা— এমনটাই অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। কুমিল্লা নগরীর নেউরা-সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, “২৫ মে আমার মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে হাসপাতালের ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডের ওটিতে যাই। সেখানে তিন জন কাজ করছেন, তাদের কারো গায়ে হাসপাতালের নির্দিষ্ট পোশাক ও পরিচয়পত্র ছিল না। ব্যান্ডেজসহ সব কাজ করছেন ওইসব লোক।” মনিরুল আরো বলেন, “যখন ব্যান্ডেজ শেষ; তখন দু’জন নারী চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লিখেছেন একটি সাদা কাগজে। এতে অ্যান্টিবায়োটিকসহ চারটি মেডিসিন দিয়েছেন বলে জানান। বলার পরও তারা ডাক্তারের সিল ও স্বাক্ষর দিতে রাজী হননি।”
জানতে চাইলে ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডের ইনচার্জ মো. ইব্রাহীম বলেন, “ওইদিন যে তিন জন দায়িত্ব পালন করেছেন তারা আউটসোর্সিং কর্মী। তারা কাজ করতে করতে এরইমধ্যে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। তবে তাদের পরিচয়পত্র ও পোশাক ছাড়া দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।” এদিকে, সরকারী এ হাসপাতালটিকে ঘিরে গত কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক ও প্যাথলজি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে কর্মরতদের ‘বিশেষ সুবিধা দিয়ে’ প্রতিদিন দালালরা চিকিৎসালয়টির বিভিন্ন শাখায় দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চিকিৎসকরা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিলে এসব দালাল উন্নত চিকিৎসার টোপ দিয়ে কৌশলে নিজেদের পরিচিত ক্লিনিক ও প্যাথলজিতে নিয়ে যান রোগীদের। সেখানে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এমন সব চিকিৎসকের নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হচ্ছে, যারা ওইসব ক্লিনিক-প্যাথলজিতে আসেন না বলেও জানা গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের জরুরী বিভাগের মূল গেট থেকে জরুরী বিভাগ, বহির্বিভাগ ও ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ড পর্যন্ত কয়েকটি স্তরে বিভিন্ন ক্লিনিক-প্যাথলজির নিয়োগ করা অর্ধশতাধিক দালাল অবস্থান করছেন। জরুরী বিভাগের ভেতরে রয়েছে আরো অন্তত ১৫ জন। জরুরী বিভাগের পাশাপাশি বহির্বিভাগের চিকিৎসকের প্রতিটি কক্ষের ভেতরে একজন, কক্ষের সামনে একজন করে দালাল দাঁড়িয়ে থাকেন। জরুরী বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স দুলাল চন্দ্র সূত্রধরসহ কয়েকজনের সঙ্গে এসব দালালের সখ্য রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসপাতালে আসা সামছুল আলম, মেজবাহ উদ্দীন, কামাল হোসেনসহ একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দালাল চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে অনেক সময় রোগীদের এসব সেবা দেয়া হয় না। বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে রোগীদের দালালচক্রের মাধ্যমে পাঠানো হয় প্রাইভেট ক্লিনিকে। সুযোগমতো দালালরাও উন্নতমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে বসে রোগীর স্বজনদের কাছে। এ ছাড়া গ্রামের সহজ-সরল রোগী পেলে ভালো চিকিৎসার কথা বলে বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে ‘বিপদে ফেলে দেয়া হচ্ছে।’
দালালদের সঙ্গে সখ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন দুলাল চন্দ্র সূত্রধর। হাসপাতালটির পরিচালক শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, “এই হাসপাতালে দালালের সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। তবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি ভালো। দালালদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। দুই-তিনদিন পরপরই দালালরা ধরা পড়ছেন। দালাল নির্মূলে অভিযান চলমান জানিয়ে পরিচালক বলেন, “আমরা চাই, রোগীরা যেন এখানেই সব সেবা পান। এজন্য রোগীদেরও সতর্ক থাকা এবং দালালের ফাঁদে পা না দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।” ক্যাজুয়েলিটি বিভাগের বিষয়ে তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে এমন একটি অভিযোগ পেয়েছি। বর্তমানে পরিচয়পত্র ও পোশাক ছাড়া কোনো স্টাফ সেখানে ডিউটি করতে পারছে না। আর চিকিৎসকের সিল ও স্বাক্ষর ছাড়া ব্যবস্থাপত্র না লিখতে বলা হয়েছে। আমরা প্রতিটি বিষয়ে সতর্ক থাকার চেষ্টা করছি। আশা করি, অচিরেই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দালালমুক্ত করতে পারব।” ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ১০০ রোগী ভর্তি থাকছেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ