দেশের বর্তমান অর্থনীতির বৃহত্তর খাত আবাসন শিল্পে চলছে সংকট। যদিও করোনাকালীন ও বৈশ্বিক মন্দার সংকট কাটিয়ে সাফল্যের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছিল, বর্তমানে সেখান থেকে অনেক দূরে পিছিয়ে গেছে এ শিল্প।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এ খাতে ২৫ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রীত এবং বিক্রীত ফ্ল্যাটগুলো সঠিকভাবে সঠিক সময়ে হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। ২০১২ সাল থেকে এ খাতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ফ্ল্যাটের বিক্রী কমে যাওয়ায় এ খাতে বিনিয়োগ থমকে গেছে। বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এলেও এ খাতের মন্দাভাব কাটেনি। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ খাতে অর্থায়ন করা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতিও এ শিল্পে সংকটের জন্য দায়ী। ফলে বেড়েছে ফ্ল্যাটর দাম, কমেছে বিক্রী।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউসিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাব সূত্রে জানা যায়, ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রী হয়েছে। ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে বিক্রী হয় ১২ হাজারের বেশী ফ্ল্যাট। ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৪ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রী হয়। ২০২০ সালের জুলাই-২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রী হয়েছে। এরপর ড্যাপ বাস্তবায়ন আর নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রী কমে আসে ফ্ল্যাটের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রী হয় ১০ হাজারের কাছাকাছি। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরো কমে সেটি ১০ হাজারের নিচে অবস্থান করছে। এদিকে বিক্রী কমলেও দাম কমেনি ফ্ল্যাটের।
মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে দাম। তিন বছর আগে যেসব ফ্ল্যাট প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা, সেটা এখন চলে গেছে ৮-১০ হাজারে। সবচেয়ে বেশী দাম বেড়েছে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টের। এ অবস্থায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের আগে সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব দেন আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা। তবে বাজেটে সেসব দাবী ফিকে হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। যদিও বিনা প্রশ্নে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। তবে এ খাতের নানা উপকরণের ওপর বাড়তি শুল্ক মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবেই দেখছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নির্মাণ খাতের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান ইটের ওপর বেড়েছে কর, শুল্ক বসেছে প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং তৈরীতে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের পণ্যে। ভ্যাট বেড়েছে জেনারেটর ও এসিতে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের মূল দাবী ভ্যাট-ট্যাক্স, রেজিস্ট্রেশন খরচের বিষয়েও ইতিবাচক কিছু নেই চলতি অর্থবছরের বাজেটে। আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বাজেটে আর্থিক খাত সংস্কারের বলিষ্ঠ কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। ডলারের উচ্চমূল্য, রিজার্ভের পতন প্রভাব ফেলেছে সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ ছাড়া ব্যাংকখাতে দুর্দশার কারণে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা আগের মতো ব্যাংক থেকে ঋণের সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের চলতে হচ্ছে নিজের পায়ে ভর করে। সব মিলিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে আবাসন খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আবাসন খাতে সংকটের আরেকটি কারণ হলো, নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপে (২০২২) যুক্ত হওয়া ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার)। জমি অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা-আকারে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এতে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ী-জমির মালিক উভয়েই। আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ফার অনুযায়ী নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন দিচ্ছে রাজউক। এতে নতুন প্রকল্প কমে যাওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ছে আবাসন খাত। তবে রাজউক বলছে, সবার জন্য জনকল্যাণমূলক বাসযোগ্য শহর করতে চায়। এটা গুরুত্ব দিয়েই খসড়া ইমারত নির্মাণ নীতিমালা করা হয়েছে।
রিহ্যাব সূত্র বলছে, প্রতি বছর সাধারণত ১৮ থেকে ২০ হাজার প্ল্যান পাস হয়। রাজউকের ৮ জোনের প্রতিটিতে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার প্ল্যান পাস করা হতো। ফার ও ড্যাপ ইস্যুতে এখন সেখানে এক হাজার থেকে ১২শ’ প্ল্যান পাস হচ্ছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালার খসড়া অনুযায়ী, কোনো এলাকায় ২০ ফুট রাস্তার ‘ফার’ ২ হলে করা যাবে চারতলা বাড়ি। ২০ ফুটের নিচে হলে ‘ফার’ আরো কমে দেড় বা পৌনে দুই হবে, যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিনতলা বাড়ি করা যাবে। এতে জমি দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না মালিকরা। কারণ ডেভেলপার কোম্পানী যেসব জমি নেয় সেখানে দুই থেকে তিনতলা বিল্ডিং ভেঙে ডেভেলপ করে। এতে জমি ডেভেলপ হলেও বাড়ি তিনতলাই থাকছে। এ কারণে ফার ইস্যুতে বৈষম্যের কথা বলছেন অনেক ভূমি মালিক। একই অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীদেরও। রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং ব্রিক ওয়ার্কস লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ড্যাপের কারণে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিকল্পিত নগরায়নের অন্তরায় ‘ফার’ বা ‘ড্যাপ’ কোনোটাই যাতে না হয় এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা ও আয়তনের সঙ্গে ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমবে।
এতে প্ল্যান পাস হচ্ছে না। আগামীতে ব্যবসায়ীরা আবাসন খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন, জমির মালিকও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকার বড় ধরনের রাজস্ব হারাবে। ফ্ল্যাট বিক্রী কম হওয়ার পরও দাম বেশী নিয়ে তিনি বলেন, কোনো প্রকল্প শেষ হতে দু-তিন বছর সময় লেগে যায়। এখন বিক্রী হওয়া ফ্ল্যাটও ওই সময়ের। এ সময়ের মধ্যে নির্মাণ উপকরণের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। সমন্বয় করা হয়েছে দাম। নির্মাণের প্রধান উপকরণ রডের দাম লাখ টাকার কাছাকাছি, ইট-বালু-সিমেন্টের দামও চড়া। এখন চাইলেই আপনি লোকসানে ফ্ল্যাট দিতে পারবেন না। নির্মাণ উপকরণের দাম কমলে আবার মধ্যবিত্তের নাগালে চলে আসবে দাম।
রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আবাসন খাতকে গতিশীল করার জন্য সরকারের যে ধরনের নীতি সহায়তা দরকার ছিল তা বাজেটে ছিল না। সরকারী সহযোগিতা ছাড়াই বেসরকারী উদ্যোক্তাদের একান্ত চেষ্টায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা গড়ে ওঠে। নিজের প্রচেষ্টা চলতে থাকে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখে। দীর্ঘদিন এ খাত ভালো চলছিল কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে অতিমাত্রায় কর আরোপ ও সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে ক্রমে দেশের আবাসন খাত মারাত্মক সংকটে পতিত হয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ