গত এক বছরে আমানতের ওপর সুদহার প্রায় দ্বিগুণ। তবুও গত সাত মাস ধরে বাড়ছে মানুষের হাতে নগদ টাকা। মূলত চলমান মুদ্রাস্ফীতির চাপে ব্যাংকে টাকা জমানো সুযোগই পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ওপর অনাস্থা তো আছেই। ফলে মানুষ অর্থ জমানো থেকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার তাগিদের নিজেদের কাছে অর্থ রাখছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মে মাস শেষে ব্যাংকের বাইরে (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) বা মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৭১ লাখ কোটি। গত ২০২৩ সালের অক্টোবরে এই পরিমাণ ছিল ২.৪৬ লাখ কোটি টাকা।
এর পর থেকে প্রতিমাসে বেড়েই চলেছে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ। সে হিসাবে গত ৭ মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি। এর মধ্যে গত মে মাসেই এই পরিমাণ ৬ হাজার ৩১০ কোটি টাকা বেড়েছে।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের খরচ করার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে তাদের সঞ্চয় কমছে। তাই ব্যাংকে আমানত বা ডিপোজিট সেভাবে করতে পারছে না। পাশাপাশি বেশ কিছু ব্যাংক নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হওয়ায় অনেকেরই ব্যাংকে ডিপোজিট করার ক্ষেত্রে কিছুটা অনীহা রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে গেল মে মাসে দেশের মূল্যস্ফীতি সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯.৮৯ শতাংশে পৌঁছেছে। গত ১৫ মাস ধরে মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি।
ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কেন বাড়ছে—জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘নো ইওর কাস্টোমার’ (কেওয়াইসি) বা ‘ভোক্তাকে জানুন’ এবং অ্যান্টি মানি লন্ডারিং (এএমএল) বা অর্থ পাচারবিরোধী নিয়মনীতিসহ বেশ কিছু আইন-কানুন করে দিয়েছে। ব্যাংকিং কাঠামো দিন দিন কঠিন হচ্ছে। এটি সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য ভালো হলেও অনেকেই এখন কালো টাকা ব্যাংকে জমা করছে না। নিয়ে এলেই ধরা পড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এটিও ব্যাংকের বাইরে টাকা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যাংকের বাইরে এত টাকা থাকা উদ্বেগের বিষয়। ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণের অন্তত এক বছরে ট্রেন্ড নিয়ে গবেষণা হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন এই ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, মে মাসে মোট আমানত ১৭ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে— যা এপ্রিলের তুলনায় কিছুটা বেশি এবং আগের বছর একই সময়ের তুলনায় ৮.৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি। এর মধ্যে টাইম ডিপোজিট বেড়েছে ৯.৭৬ শতাংশ এবং ডিমান্ড ডিপোজিট বেড়েছে ১.৩৬ শতাংশ। সর্বোপরি এপ্রিলে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৬৩ শতাংশ। ইস্টার্ন ব্যাংকের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, অনেকেই এখন ব্যাংকে টাকা আমানত করার বদলে সরকারের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। বন্ডের সুদের হার ভালো, ব্যাংকগুলোর ডিপোজিট রেটের চেয়ে বেশি হওয়ায় অনেকেই বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। ব্যাংক খাতে আমানত কমার এটিও একটি কারণ হতে পারে। তবে সব ব্যাংকের অবস্থা এক রকম নয়। যেমন— আমাদের ব্যাংকে বর্তমানে টার্গেট অনুযায়ী ডিপোজিট গ্রোথ না হলেও বেশ ভালো গ্রোথ হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সুদহার বেশি হওয়ার পাশাপাশি সরকারি বন্ডে টাকা রাখা ব্যাংকের তুলনায় বেশি নিরাপদ বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। এছাড়া, ব্যাংক সুদের ওপর ট্যাক্স কাটা হয় বা ডিপোজিট লিমিটের উপর আবগারি শুল্ক দিতে হয়, কিন্তু বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এমন খরচ নেই।
সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, আমানতের ক্ষেত্রে সব ব্যাংকের চিত্র সমান নয়। যেমন—ব্র্যাক ব্যাংকে আমানতের ইয়ার অন ইয়ার গ্রোথ হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কিছু ইসলামী ধারার ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি ধীরগতি হয়েছে। আবার অনেক ব্যাংকে গ্রাহকের আস্থার ঘাটতির কারণেও আমানত কমতে পারে। এর বাইরে বেশ কিছু মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকায় মানুষের খরচও বেড়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বাড়াতে এবং ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকা কমাতে হলে ক্যাশ ট্রান্সেকশন (নগদ লেনদেন) কমাতে হবে। আমাদের এখন ডিজিটাল ব্যাংকিং বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও এখন ধীরে ধীরে ক্যাশ ট্রান্সেকশন থেকে সরে আসছে, ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। ক্যাশলেস ডিজিটাল সোসাইটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটিই সঠিক পথ।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ