ভর্তুকিতে কাটছাঁটে রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা ক্ষতিতে ফেলবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। প্রণোদনা বাদ পড়লে অনেক শিল্পের বিকাশ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রণোদনার বিকল্প তৈরী না করে কমালে বিপরীত হতে পারে। তাই পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে তা কমানো উচিত বলে পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। তাদের দাবী, এলডিসি থেকে উত্তোরণ হওয়া দেশগুলো তাদের রপ্তানী খাতে যেসব সুবিধা দিয়েছে, সেসব পদক্ষেপ বাংলাদেশকেও নিতে হবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১৩তম মন্ত্রী পর্যায়ের সভা শেষে প্রথমবারের মতো চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি রপ্তানীমুখী পণ্যের ওপর থেকে নগদ প্রণোদনা কমায় সরকার। এর পাঁচ মাস না যেতেই গত ৩০ জুন আরেক দফা কমানো হলো এ প্রণোদনা। এলডিসি থেকে বাংলাদেশের ২০২৬ সালে উত্তরণের কথা, এর মধ্যেই দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে হবে। তবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এলডিসির হিসাবেই বিভিন্ন সুবিধাই মিলবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের ধাপে সংস্কারের অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে বেসরকারী খাত। সেই বেসরকারী খাতকে প্রস্তুত করতে সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই কমানো হয়েছে প্রণোদনা। রপ্তানী করা পণ্যের মূল্যের ওপরে নগদ সহায়তা দেয় সরকার। এক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতের পণ্যের রপ্তানী মূল্যের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন সহায়তার হার নির্ধারিত। নগদ সহায়তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী তৈরী পোশাক ও বস্ত্র খাত। এত দিন রপ্তানীতে তৈরী পোশাক খাতের একটি কারখানা ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা পেত। এখন সেটি কমে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশে দাঁড়াবে। একইভাবে চামড়াজাত, পাটজাত, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, আসবাব, প্লাস্টিক পণ্য, চা, ওষুধ ইত্যাদি পণ্য রপ্তানীতেও নগদ সহায়তাও কমছে।
এ সহায়তা কমলে অনেক কারখানাই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ব্যবসার খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে প্রণোদনা কমছে। এতে পণ্য রপ্তানীতে কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। তবে আর্থিক প্রণোদনা কমানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে অভিমত অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কোনো ধরনের রপ্তানী প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানী খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই এখন থেকে একটু একটু করে সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবস্থায় আর্থিক প্রণোদনা কমানো হলে কিছুটা চাপে পড়বে রপ্তানীকারকরা। তবে আর্থিক প্রণোদনা এখন থেকে না কমালে ভবিষ্যতে এ চাপ আরও বাড়বে। একই সঙ্গে আর্থিক প্রণোদনা না দিয়ে বিকল্প উপায়ে রপ্তানীকারকদের সমস্যা-সংকট মোকবিলায় এখন থেকেই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ জানুয়ারি যে সার্কুলার দেয়, তাতে দেখা যায়, রপ্তানীমুখী বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে অর্ধেক বা দেড় শতাংশ করা হয়েছে। আর ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানীকারকদের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
পোশাক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারী কারখানার রপ্তানী প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন পণ্য বা নতুন বাজারে প্রণোদনা ৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২ শতাংশ। আর রপ্তানীতে বিশেষ নগদ সহায়তায় সবচেয়ে বেশী সংস্কার এসেছে, ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। পোশাক খাতের পর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানী খাত। বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানী কমেছে ১৪ শতাংশ। ধুঁকতে থাকা এ খাতেও প্রণোদনা কমছে। যদিও ক্রাস্ট লেদারে (রপ্তানীযোগ্য চামড়া) প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে।
এ দফায় চামড়াজাত পণ্য রপ্তানীতে প্রণোদনা ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া ক্রাস্ট লেদার রপ্তানীতে ৬ শতাংশ প্রণোদনা মিলবে। আর ফিনিশড লেদারে প্রণোদনা ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানীতে কয়েক বছর ধরে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে এ খাত থেকে ৮৫ কোটি ডলারের রপ্তানী আয় এসেছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। নতুন নিয়মে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানী কমছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রপ্তানী কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। ধুঁকতে থাকা এ খাতেও রপ্তানীতে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০, পাটজাত পণ্যে ৭ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং পাট সুতায় প্রণোদনা ৫ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে হালকা প্রকৌশল পণ্য রপ্তানীতে নগদ সহায়তা ১২ থেকে ১০ শতাংশ, ওষুধের কাঁচামালে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫, বাইসাইকেল রপ্তানীতে সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ এবং আসবাব পণ্য রপ্তানীতে নগদ সহায়তা ১০ থেকে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া হিমায়িত চিংড়ি, মোটরসাইকেল, ইলেকট্রনিকস, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজ, প্লাস্টিক পণ্য, হাতে তৈরী পণ্য যেমন- হোগলা, খড়, আখ বা নারিকেলের ছোবড়া, তৈরী পোশাক কারখানার ঝুট, গরু, মহিষের নাড়ি, ভুঁড়ি, শিং ও রগ, কাঁকড়া, কুঁচে, আগর, আতরসহ ৪৩টি খাতের প্রায় সব পণ্যের রপ্তানীতেই নগদ সহায়তা বিভিন্ন হারে কমানো হয়েছে।
দেশের রপ্তানী আয়ের ৮৫ ভাগই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। তবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে এ খাত। রপ্তানীতে নগদ প্রণোদনা বাদ দেয়া হলে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে দেশের তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানীকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
রপ্তানীতে প্রণোদনা বাদে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচি। তিনি বলেন, আমরা এমনিতেই বিপদে আছি। কারখানাগুলোতে গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে এমনিতেই অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে আছে। ব্যাংক থেকে লোন নেয়া যাচ্ছে না, প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে, শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে এমনিতেই আমরা একটু নড়বড়ে অবস্থায় আছি। বিদেশে অর্ডারের পরিমাণও এখন কম। এমন অবস্থায় হুট করে ৩০ তারিখ (জুন মাসের) সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রণোদনা কমানো হল। সেটা আবার ১ জুলাই থেকে কার্যকরও করে দেয়া হলো।
আমরা যেসব অর্ডার নিচ্ছি গত কয়েক মাস ধরে তা তো এ প্রণোদনা হিসাব করেই নিয়েছি। এটা তো ঠিক হলো না। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানীকারকদের সঙ্গে কথা বলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি। বাংলাদেশের রপ্তানীতে নগদ প্রণোদনার বিকল্প ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করছেন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ২০২৬-এর নভেম্বর মাসের পর আমরা কোনো আর্থিক প্রণোদনা বেসরকারী খাতকে দিতে পারব না। ফলে এখন থেকেই এটা কমানো উচিত। তাই করছে সরকার। তিনি বলেন, কিন্তু রপ্তানীকারকরা অনেক সমস্যার মধ্যে আছে। সেসব সরকারকে এড্রেস করতে হবে। সেগুলো কমানোর উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। আর্থিক প্রণোদনা না দিয়েই বিকল্প ভাবার সময় এসেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও কিন্তু তাদের রপ্তানীকারকদের নানা রকমের সহযোগিতা করেন। সেই মডেলে আমাদেরও কাজ করতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন জানিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুসারে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের পর কোনো ধরনের রপ্তানী প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেয়া যায় না।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানী খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই এখন থেকে একটু একটু করে সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিকল্প কী কী সুবিধা দেওয়া যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। সময়মতো আমরা সেগুলো সামনে আনব। ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরও বিভিন্ন নামে তাদের রপ্তানী খাতে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। ভারত ২০১৪ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি চালু করেছে, যাতে কোম্পানীগুলোকে দেশটিতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা যায়। আর এর মাধ্যমে পণ্যের উৎপাদন ও বিকাশ হয়। আর ভারত নানা স্কিমের মাধ্যমে রপ্তানীকারকদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু পণ্য রপ্তানী নয় সেবা খাতেও দিচ্ছে প্রণোদনা। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম ১৫ হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের সেবা রপ্তানী করতে পারে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান ৩ থেকে ৭ শতাংশ প্রণোদনা পাবে। কিন্তু ভারত এটি দিচ্ছে ‘রপ্তানী পুরস্কার’ হিসেবে। এছাড়া ভারত রপ্তানীকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর ছাড় দেয়ার জন্য তৈরী করেছে আলাদা স্কিম। অন্যদিকে, রপ্তানী পণ্য তৈরীর জন্য যদি কাঁচামাল আমদানী করা হয়, তাতেও দেশটি শুল্ক শূন্য রেখেছে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্য রপ্তানীকারকদের সুবিধার জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে রেখেছে। ভারত এসব করে শুধু খরচ কমানো নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়লে তাকে রক্ষায় ‘নির্ভীক’ নামে একটি স্কিমও চালু করেছে। এর অধীনে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯০ শতাংশ পর্যন্ত লোকসান পূরণ হয়। এ স্কিমের ফলে ছোট রপ্তানীকারকদের উচ্চ বীমা ও প্রিমিয়াম কমিয়ে রাখা হয়।
এমনকি কোনো উদ্যোক্তা যদি ১০০ শতাংশ রপ্তানীমুখী কারখানা স্থাপন করেন, তাহলে তার জন্য কমপ্লায়েন্সে ও ট্যাক্সে ছাড় দেয়া হয় আরেকটি স্কিমের মাধ্যমে। ভারত মার্কেট এক্সেস ইনিশিয়েটিভ স্কিমের মাধ্যমে রপ্তানী প্রচার সংস্থা, বাণিজ্য প্রচার সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পরীক্ষাগারের জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন খাতের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক স্কিম। ভিয়েতনাম অনেক আগে থেকেই শিল্প ও দক্ষতা বাড়াতে আর্থিক সুবিধা চালু করেছে। চীনও প্রযুক্তির মানোন্নয়নের নামে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে তাদের উদ্যোক্তাদের। তাদেরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন খাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ