ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

সুপেয় পানি নিশ্চিত করা হোক

প্রকাশনার সময়: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১০:১৫

খুচরা পর্যায়ে আধা লিটার পানির বোতলে লাভ ৮-৯ টাকা! এমন আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়ে এগিয়ে চলছে ছাত্র-যুব-জনতার বাংলাদেশ। তার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আধা লিটারের এক বোতল পানি পাইকারী পর্যায়ে বিক্রী হচ্ছে ১১-১২ টাকায়; অথচ এ একই পানি খুচরা বিক্রেতারা বিক্রী করছেন ৮ থেকে ৯ টাকা লাভে। আধা লিটারের একেকটি পানির বোতল খুচরা পর্যায়ে বিক্রী হচ্ছে ২০ টাকায়, যেখানে খুচরা দোকানীরাই লাভ করছেন ৮-৯ টাকা।

এই তো কিছুদিন আগের কথা, তখন ৫০০ মিলি লিটারের পানির বোতলের দাম ছিল ১৫ টাকা। সেখান থেকে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এখন দাম বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে এক লিটার, দুই লিটার, তিন লিটার ও পাঁচ লিটারের পানির বোতলের দামও বাড়ানো হয়েছে। আধা লিটারের এক বোতল পানি পাইকারী পর্যায়ে বিক্রী হচ্ছে ১১-১২ টাকায়। একই পানি খুচরা বিক্রেতারা বিক্রী করছেন ৮ থেকে ৯ টাকা লাভে। এ লাভ স্বাভাবিকের তুলনায় যেমন বেশী, তেমনই জনবিরোধী। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে মানুষ যখন নানাভাবে বিপদগ্রস্থ, দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ, তখন পানির দাম বৃদ্ধিও মানুষকে বাড়তি চাপে ফেলেছে। এটি অযৌক্তিক এবং ভোক্তা স্বার্থবিরোধী বিধায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী-বাণিজ্যমন্ত্রী-পানি সম্পদ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই- বোতলজাত পানির দাম কমাতে পদক্ষেপ নিন। কেননা, পানির অপর নাম জীবন, এ জীবন নিয়ে অতি মুনাফা বন্ধ হওয়াটা খুবই জরুরী। সব ধরনের বোতলজাত পানির অযৌক্তিক মূল্য বাতিল করে ভোক্তা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ করাটাও এখন সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে আমি মনে করি।

একই সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বোতলজাত পানির দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে ভোক্তা সাধারণকে কষ্টে ফেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়াটাও প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সেই সঙ্গে বলে রাখি- প্রতি বছর দেশে ৩৫-৪০ কোটি লিটার বোতলজাত পানি বিক্রী হচ্ছে। প্রতি বছর ১৫-২০ শতাংশ হারে পানির চাহিদা বাড়ছে। সেই সঙ্গে চরম একটা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরছি। রাজধানী ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে আশি, নব্বই এবং একবিংশের প্রথম দশকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছিল টিউবওয়েল এবং ওয়াসার পানির কল। সেই সময়ে যে কোনো নাগরিক চাইলেই পানি পান করতে পারতেন এ বিভাগীয় ও জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে। চলতি সময়ে এসে সেই টিউবওয়েল আর ওয়াসার পানির কল হারিয়েছে। সাধারণ মানুষ হারিয়েছে পিপাসায় পানি খাওয়ার শেষ সুযোগটুকু। মধ্যিখানে বেড়েছে বোতলজাত পানি বিক্রীর রামরাজত্ব।

বিশ্বব্যাপী প্রায় সব শেষে সুপেয় পানি পান করার সুব্যবস্থা করে রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে সেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। অথচ সাধারণ মানুষকে পানি পান করানোর জন্য পৃথিবীর প্রায় সব শাসক করেছে সর্বোচ্চ আন্তরিক প্রচেষ্টা। ইতিহাস বলছে, ১৮৭৮ সালে ঢাকায় প্রথম স্থাপিত হয় ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তরদিকে অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এ ট্যাংকটি ‘বাহাদুর শাহ পার্ক পানির ট্যাংক’ নামে পরিচিত। এর লাল ইটের প্রাচীর কাঠামো, স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণ কৌশল এতই অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র যে পথচারীদের নজর কেড়ে নিতে বাধ্য। কিছুটা গম্বুজের মতো দেখতে দানবীয় এ স্থাপনাটি লম্বায় প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান।

স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন একটা বিশাল বড় বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সাত বছর বয়সী ফারদিন। এত উঁচু বিল্ডিং আর কোথাও দেখেনি সে। আশপাশের সব কিছুর চেয়ে উঁচু এ বিল্ডিং। দৈত্যাকৃতির এ বিল্ডিংটির মাথাটা একদম গোল। দেখে মনে হয় যেন একটা গোল ঘর। আচ্ছা এ ঘরে কি কোনো মানুষ থাকে? একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দাদুকেই প্রশ্নটা করে বসল সে। ‘দাদু এখানে কারা থাকে?’ প্রশ্ন শুনেই দাদু হেসে দিলেন। বললেন, ‘এটা কারো বাসা নয় দাদু, এটা হলো পানির ট্যাংক। এখানে আগে পানি রাখা হতো। এখান থেকেই পানি যেত সবার বাসায়।’ ‘পানির ট্যাংক!’ উত্তর শুনে ফারদিনের চোখেমুখে বিস্ময়। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না কীভাবে এত উঁচুতে আগে পানি থাকত! নাতীর বিস্ময় দেখে দাদা বুঝতে পারলেন, এ ট্যাংকগুলো আসলেই এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। অথচ ঢাকাবাসীকে এক সময় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এ ওভারহেড ট্যাংকগুলোই। ১৮৭৮ সালের ২৪ মে থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ট্যাংকটি ব্যবহার করা শুরু হয়। ঠিক কবে এ ট্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায় সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ বলেন পাকিস্তান আমলেই এটি বন্ধ হয়ে গেছে, আবার কারো মতে, ২০ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। যখনই বন্ধ হোক, ১৪৫ বছর বয়সী এ পানির ট্যাংকটি বর্তমানে কেবল একটি অকেজো, জরাজীর্ণ বিশাল স্তম্ভ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। ২০২০ সালের মে মাসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক এ ট্যাংকটিকে একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু তাতেও কোনো সুনজর আসেনি এ ব্রিটিশ-নবাব নিদর্শনের ওপর। এখন পর্যন্ত এটি সংরক্ষণের কোনো বালাই তো নেই-ই, উল্টো এর ভিতরে চলছে মাজার ব্যবসা। বহুদিন আগেই ট্যাংকটি চলে গেছে দখলদারের খপ্পরে। ট্যাংকের নিচের খালি জায়গায় কয়েক দশক আগে স্থাপিত হয়েছে মাজার। গত বছর বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন হয়েছে এটি নিয়ে। বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ঢাকাবাসীর কাছে যেন তার পুরোনো গৌরব আর ইতিহাসেরই জানান দেয় ঢাকার এ প্রথম পানির ট্যাংক। যখন সারা দেশের মতো রাজধানী ঢাকায় চরম রকম সুপেয় পানি সংকট চলছে, চলছে বোতলজাত পানি বিক্রীর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের মহোৎসব, তখন ঘুমিয়ে আছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ওয়াসার মোট ৩৮টি অকেজো ওভারহেড পানির ট্যাংক। যার কোনোটিই আর সচল নেই। এটি ছিল ঢাকা শহরের দ্বিতীয় পানির ট্যাংক। শেওলা পড়া প্রাচীরে ঘেরা ট্যাংকের এলাকা। বাইরে ওয়াসার ওয়াটার এটিএম বুথ। প্রাচীরের ভিতর চারপাশে ঝোপঝাড়ের মতো লতাপাতা সব একপাশে স্তূপ করে রাখা। ট্যাংকের নিচের মাটি গর্ত আর পোড়া ছাইয়ে ভর্তি। পাকিস্তান আমলের পরবর্তী সময়ে স্থাপিত ট্যাংকগুলো দেখতে বেশীরভাগই সাদাটে রঙের এবং পুরোনোগুলোর তুলনায় লম্বায় অনেক বেশী উঁচু।

ট্যাংকগুলোর পাশেই আছে ওয়াসার পানির পাম্প, যেখান থেকে সরাসরি পানি সরবরাহ করা হয় এলাকাগুলোতে। হাটখোলা রোড, ফুলবাড়িয়া, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, লালমাটিয়া, মিরপুর ১০- এলাকার ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলো ঘুরে দেখা যায় প্রায় একই চিত্র। ফকিরাপুল আর লালমাটিয়ার ট্যাংক দু’টি স্টিলের তৈরী। সাধারণ ট্যাংকগুলোর চেয়ে আকারেও বেশ বড় এগুলো। যে ট্যাংকগুলোর সঙ্গে ওয়াসার জোন অফিস অবস্থিত সেগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও বাকী ট্যাংকগুলো পড়ে আছে অরক্ষিত। বিশাল আকৃতির ওভারহেড ট্যাংকগুলো মূলত ব্যবহূত হতো ওয়াসার পানি জমিয়ে রাখার কাজে। পানি শোধনাগার থেকে পরিশোধিত করে পাম্পের সাহায্য ট্যাংকে উঠিয়ে রিজার্ভ করে রাখা হতো। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল বেশ কম। বর্তমানে এ শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি দুই লাখের উপরে। বর্তমানে ঢাকার বিপুল জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহ দিতে হিমশিম খেতে হয় ওয়াসাকে। তাই রিজার্ভ ট্যাংকে পানি উঠিয়ে রাখার মতো সময় আর নেই। এখন সরাসরি লাইনে পানি সাপ্লাই করা হয় বাড়িগুলোর নিজস্ব রিজার্ভ ট্যাংকে।

যে পাম্প দিয়ে ওভারহেড ট্যাংকে পানি উত্তোলন করা হতো সেগুলোর ওপরও অনেক চাপ পড়ত। যে কারণে কয়েকদিন পরপর নষ্ট হয়ে যেত পাম্পগুলো। পাম্পের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশী হয়ে যেত এ কারণে। এ ছাড়াও বড় বড় পানির ট্যাংকের রক্ষণাবেক্ষণও ছিল বেশ ঝামেলাপূর্ণ। উঁচু ট্যাংক থেকে পানি সাপ্লাই করায় পানির চাপও হতো অনেক বেশী। যে কারণে অনেক বাসাবাড়ির পানির ট্যাপ ভেঙে যেত এ চাপে। মূলত আশির দশক থেকে বন্ধ হতে শুরু করে ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলো। কোনো কোনো পানির ট্যাংক বন্ধ হয়েছে ২০০০ সালের পর। সর্বশেষ ২০০৭ সালে আগারগাঁওয়ের পানির ট্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যকর শহর হিসেবে কখনই ঢাকার সুনাম ছিল না। এ কারণে নিয়মিত প্রতিবছর মহামারীতে ঢাকা শহরে অনেক মৃত্যু হতো। মহামারীর কারণ ছিল বিশুদ্ধ পানির অভাব। ১৮৭৮ সালের আগ পর্যন্ত ঢাকায় খাবার পানির উৎস ছিল বুড়িগঙ্গা, বিভিন্ন পুকুর-ডোবা, নোংরা পাতকুয়ো। তখন বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহের কাজ করত সাক্কা বা ভিস্তিওয়ালা নামের পেশাজীবীরা। গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত মশকের সাহায্যে পানি সরবরাহের কাজ করত তারা।

আজ ভিস্তিওয়ালা ছাড়াই সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে পারে রাষ্ট্র, এজন্য কেবল লোভ-মোহ আর দুর্নীতির বাইরে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী আর রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর। দুর্নীতির কারণে এখন বোতলজাত পানি নাগরিক জীবনে এক কষ্টপর্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন, তেমনই অযৌক্তিক মূল্যের খড়গের নিচে মাথা দিয়ে থাকতে হচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতাকে। জনবিরোধী-দুর্নীতির হাত ধরে নয়, জনবান্ধব হয়ে এগিয়ে এলে খুব সহজেই সুপেয় পানির মাধ্যমে মানুষের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখা সম্ভব। তাই চাই- বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর বিশেষ পয়েন্টগুলোতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হোক। তা না হলে প্রতি বছর শুধু পর্যাপ্ত পানি পান না করতে পারায় এখন যেমন বছরে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, আগামীতে তার সংখ্যা আরো বাড়বে; যা কোনো সচেতন নাগরিকের তো নয়ই, কাম্য নয় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা দিয়ে এগিয়ে চলা সরকার সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের।

লেখক: চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ