ঢাকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

প্রতিবেশী ও ভারত

প্রকাশনার সময়: ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৯:৩০

মানুষ একাকী বাস করতে পারে না, তাই মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল আচরণের মধ্য দিয়ে মানুষকে বসবাস করতে হয়। ঠিক তেমনি কোনো রাষ্ট্রের স্থানকে ঘিরে থাকা তাৎক্ষণিক ভৌগোলিক এলাকা দ্বারা এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ভারতীয় উপমহাদেশের গর্ভে ছিল বাংলাদেশ, যখন এ উপমহাদেশটি মোগল ও ব্রিটিশ কর্তৃক শাসিত হয় সেই সময়।

১৯৪৭ সালে তথাকথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশটি ভাগ হওয়ার পর বাংলাদেশ নামক ভৌগোলিক অংশটা ভিন্ন সংস্কৃতির ধারার শাসনে চলে যায়, আর তখন বাঙালিরা এ শোষণের শৃংখল থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। ভিন্ন সংস্কৃতির ধারার পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ আক্রমণে লাখ লাখ বাঙালি প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয়। বাঙালি জাতির মহান মুক্তিসংগ্রামে ভারত সৎ প্রতিবেশী সুলভ সহযোগিতা করে। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সহযোগিতা পেয়েছিল বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে যে সহযোগিতা করেছিল তা ছিল প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর দায়িত্ব ও কর্তব্য বিবেচনায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে।

বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা সুপ্রতিবেশী সুলভ বিদ্যমান রয়েছে যা থাকবে আজীবন। তবে লেনদেনের ভারসাম্যটা কতটা আছে, তা বিবেচনায় নেয়া দরকার। ভারতের বর্তমান কর্মকাণ্ডগুলো অনেকটা বাংলাদেশের উপর দাদাগিরি ফলানো মতো বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ভাটি অঞ্চল। মূলত বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি সুকান্তের মতে, হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চলের দেশ হওয়ার ফলে হিমালয় বা মেঘালয় থেকে উৎপন্ন নদ-নদীর জলধারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগর সঙ্গমে মিশেছে। ভারতে পড়েছে বাংলাদেশের নদ-নদীর উজানের জলধারা। আর ভারত যদি উজানের জলধারাটা বাধাগ্রস্ত করে তাহলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। ভারত থেকে বাংলাদেশে মোট ৫৪টি নদ-নদী প্রবেশ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পদ্মা যা ভারতের অংশে গঙ্গা, যমুনা ও তিস্তা যা ভারতের অংশে বহ্মপুত্র, আসাম অঞ্চলের বারাক নদী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এ দুইটি হলো সুুরমা ও কুশিয়ারা। এ নদী দুইটি আবার ভৈরবে মিলিত হয়েছে। তারপর মেঘনা নামে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের মূলত প্রধান তিনটি নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এ তিন নদী থেকেই অসংখ্য নদীর সৃষ্টি হয়েছে । মূলত বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, কারণ দেশটি উপমহাদেশের ভাটি অঞ্চল তাই এখনাকার অধিকাংশ ভূমিই প্লাবন সমভূমি।

বাংলাদেশের অধিকাংশ এলকা প্লাবন সমভূমি হওয়ায়, কৃষি জমিগুলো ছিল অত্যন্ত উর্বর। এখানকার কৃষির আবাদটা ছিল প্রাকৃতিক জল সেচের উপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিকভাবে হতো কৃষির সেচ ব্যবস্থা, উজানের জলে বয়ে আসা পলি ছিল জমির অন্যতম সার, তাই বাংলাদেশের উৎপাদিত খাদ্য পণ্যগুলো ছিল পুষ্টিমান সমৃদ্ধ। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের খ্যাতি হাজার বছরের। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষির উৎপাদন আর প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় সম্কন্ন হয় না। বাংলাদেশে প্রবেশ করা নদীগুলোর উপর ভারত বাঁধ দেয়ায় দেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। বাংলাদেশের কৃষির সেচ ব্যবস্থা চালু রাখতে হচ্ছে ভুগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে। ভারত গঙ্গা নদীর উপর ১৯৬১ সালে একটি বাঁধ নির্মাণ শুরু করে যা শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল। এ বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২২৪০ মিটার। এ বাঁধটির নাম ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধটি দিয়ে ভারত গঙ্গা নদীর পানি একটি ফিডার খালের মাধ্যমে হুগলী নদীতে নিয়ে যায়। ফলে উজানের পানি না আসায় বাংলাদেশে প্রবেশ করা গঙ্গা, যা পদ্মা নামে বঙ্গোপসাগরের দিকে গিয়েছে তা নাব্য হারায়। নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা বৈঠক করেও বাংলাদেশ পদ্মা নদীর জলধারাটা ফেরত পাচ্ছে না। বাঁধ দিয়ে একটি নদীর গতিপথ ভিন্ন ধারায় নিয়ে যাওয়াটা অন্যায়। নদী প্রকৃতির সৃষ্টি। নদী তার আপন গতিতে ধাবিত হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নদীর এই গতিপ্রবাহ কৃত্রিমভাবে ভিন্ন প্রণালীতে নিয়ে যাওয়াটা প্রকৃতির সঙ্গে বেইমানী করার মতো একটি কাজ।

গঙ্গার পানির অভাবে পদ্মা অববাহিকার আবহাওয়াটা দিন দিন মরু প্রবণ হয়ে যাচ্ছে। তিস্তা ও বাংলাদেশের যমুনা যা ভারতের ব্রহ্মপুত্র। এ নদী দুইটির ভারতীয় অংশটায় পানি আটকিয়ে দিচ্ছে ভারত। ফলে তিস্তা এবং যমুনা অবাহিকাটাও খরায় কবলিত গরম কালে, অপরদিকে বর্ষায় ভারতীয় অংশ পানি ছেড়ে দেয়, যার ফলে প্রবল বেগের জলধারায় বাংলাদেশের বিশাল অংশ প্লাবিত করে। বরাক নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে, এর প্রভাবে বাংলাদেশের বিশাল হাওড় এলাকায় দেখা দিবে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ভারতের নদীর পানিতে বাঁধা দেয়ার কারণে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে দেখা দিচ্ছে নেতিবাচক পরিবর্তন। এ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সৎ প্রতিবেশী মূলক আচরণ। অন্যদিকে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রেল যোগাযোগের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কলকাতা থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলী রাজ্যগুলোতে খুব দ্রুততম সময়ে পৌঁছানো যাবে এ রেল যোগাযোগ চুক্তির মাধ্যমে। ভারতের কলকাতা বন্দরটির আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। কলকাতা টু ত্রিপুরা যে রেলপথটি হবে তা প্রবেশ করবে বাংলাদেশের দর্শনা দিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে আখাউড়া স্থল বন্দর দিয়ে ট্রেন পৌঁছবে ত্রিপুরায় তারপর অন্যান্য রাজ্যে। ফলে দেখা যায় বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর মূল উপকারভোগী হবে ভারত। পদ্মা সেতুর ফলে উপকৃত হবে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের এগারটি জেলা, মনিপুরের ১৬টি, পশ্চিম ভঙ্গের ৯টি, ত্রিপুরার ৮টি, আসামের ৩৩টি মনিপুরের ১৬টি মেঘালয়ের ১৬টি জেলাসহ হিমাচল এবং অরুণাচল প্রদেশ। দেখা যায়, পদ্মা সেতুর ফলে বাংলাদেশের চেয়ে বেশী উপকৃত হলো ভারত। অথচ এক সময় কথা ছিল বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আমদানী রপ্তানীর কাজ সম্কন্ন করবে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ। এ ব্যবস্থাটা বাংলাদেশের আয় কিছুটা হলেও বাড়ত।

বর্তমানে এ অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ভারত পেয়ে যাওয়ার কারণে আর চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করবে না, তারা সরাসরি কলকাতা বন্দর থেকে মালামাল আমদানী রপ্তানী করতে পারবে। কারণ রেল যোগাযোগে পরিবহন খরচ অনেক কম। আরেকটি চুক্তির ফলে শোনা যাচ্ছে যে, ভারতের গেদে দিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় ট্রেন প্রবেশ করে সরাসরি চলে যাবে চিলহাটি হয়ে আসামসহ হিমাচল অরুনাচলের দিকে। বাংলাদেশের ভিতরে ভারত রেল নৌপথ, সড়কপথ ট্রানজিট হিসাবে পাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ রেল ট্রানজিট দেয়ার ফলে কলকাতা শহরটি আবার ব্রিটিশ শাসনামলের রাজধানীর ন্যায় প্রসিদ্ধতা লাভ করবে। অথচ পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে নদীর পানি নিয়ে কেন মোদি আলোচনা করলেন তার নিন্দা করেছেন। এ আলোচনা কারায় প্রতিবাদ হিসাবে কড়া চিঠি লিখেছেন মোদির কাছে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়াল। এতে বুঝা যায়, ভারতের কতটা কতৃজ্ঞতাবোধ আছে? দেশটি শীর্ষমহলের আচরণে কি ফুটে উঠছে অকৃৃতজ্ঞতার সুর? বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ৯২১ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ থেকে ভারত যে ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে, এ রকম সুযোগ ভারত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ থেকে পাবে না বা পায় নাই। তাই ভারতের উচিত বাংলাদেশের উজানে ভারতের যেসব বাঁধ আছে ফারাক্কাসহ সব খুলে দেয়া। সড়ক রেল নৌ ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রেল, সড়ক জলপথ বেশীর ভাগ সময়ই থাকবে ভারতীয় পরিবহনের দখলে।

তাই কতক্ষণ ভারত ট্রানজিট সুবিধা হিসাবে বাংলাদেশের পরিবহন পথগুলো ব্যবহার করবে তার একটি নীতিমালা থাকা দরকার। যে নীতিমালাটা সম্কর্কে দেশের জনগণও জানবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ট্রানজিট বিষয়ক চুক্তিগুলো দেশবাসীর কাছে কুয়াশাচ্ছন্ন। তাই ট্রানজিট বিষয়ক বিষয়টা স্বচ্ছভাবে জাতির কাছে সরকারের উপস্থান করা উচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশর অভ্যন্তরে যে আলোচনা হয় তা দেশবাসী স্কষ্টভাবে কিছু বুঝতে পারছে না। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে যা বলছে তাতে মিশে আছে ভারতীয় পক্ষপাতদুষ্টতা। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এখন ভারত তোষণ নীতিতে বিশ্বাসী। দেশবাসীর জন্য প্রাপ্য অংশটুকু তারা বুঝে নিতে চায় না, ভারতের কাছ থেকে। সম্ক্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে কেন্দ্র করে বিএনপি মহাসচিব বললেন, আমরা ভারতবিরোধী নই, তবে শেখ হাসিনার সরকারকে আমরা চাই না। এর অর্থ কি দাঁড়ায়। সবাই ভারতের ওপর ভর করে ক্ষমতায় যেতে চায়। দেশের কথিত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও নিশীকথকদের ভারত বাংলাদেশের মৈত্রী সম্কর্কিত যে কথাগুলো বলে, সেসব কথা শুনে অস্বস্তি তৈরী হয়। এরাও ভারত তোষণে ব্যস্ত। তবে ভারত ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশের ভূমি ব্যাপক হারে ব্যবহার করছে। যার নেতিবাচক ফল বাংলাদেশের জনগণকে অদূর ভবিষ্যতে পোহাতে হবে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ