ঢাকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

ফের পানিতে ভাসছে সিলেট

প্রকাশনার সময়: ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৭

টানা বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি নগরীতেও পানি প্রবেশ করেছে। এদিকে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দ্বিতীয়বারের মতো সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঢলের পানিতে এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার ঘরবাড়ি, গ্রামীণ সড়ক ও ফসলি জমি। সে সঙ্গে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে দুই লক্ষাধিক মানুষ। অন্যদিকে ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে এর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলা সদরের যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করে শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। বাড়ছে ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি। তাছাড়া নীলফামারীর ডিমলা ও শেরপুরের নকলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিস্তারিত প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের খবরে—

সিলেট: গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে সিলেট জেলা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, গত তিন দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৬৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির পরিমাণ কমেছে। যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যায় তা হলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। জেলার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে নগরীর যতরপুর, সোবাহানীঘাট, মাছিমপুর ও উপশহরের কয়েকটি স্থানে ঘুরে কোথাও কোথাও হাঁটুপানি দেখা গেছে। বন্যার পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন বাসিন্দারা। কেউ হেঁটে, কেউ রিকশা, অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করছেন। নগরীর উপশহর সি ব্লকের বাসিন্দা এরশাদ মিয়া বলেন, সোমবার রাতে বাসার ভিতরে হাঁটুপানি ঢুকে যায়। সারা রাত কষ্ট করে কাটিয়েছি সবাইকে নিয়ে। সকালে হাঁটুপানি ভেঙে বেরিয়েছি; আবার ওইভাবেই ফিরেছি। পাড়ার বেশির ভাগ ব্লকেই পানি ঢুকেছে। একই এলাকার ডি ব্লকের বাসিন্দা আহমেদ হোসেন বলছিলেন, এ নিয়ে তিন দফায় পানি উঠল বাসায়। সোমবার রাতেই বাসায় পানি উঠে; রাস্তাঘাটেও পানি। এভাবে কিছুদিন পর পর পানি উঠলে এই এলাকা ছাড়তে হবে। যতরপুর এলাকার মামুন মিয়া চারতলায় থাকেন।

কিন্তু বাসার নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ায় যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে জানান। তিনি বলেন, হাঁটু পানি ভেঙে বের হয়েছি বাজার করতে। কাজে তো বের হতেই হয়। কয়েক দিন পরপর এ যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না।সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, গত দুই দিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর পানি বেড়েছে। তবে এখনো সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের

নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা কাজ করছেন; ত্রাণ বিতরণও অব্যাহত আছে। ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বিশ্বনাথে পানি একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বাড়ার কারণে আবার আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আসছেন।

কুড়িগ্রাম: পাউবো কুড়িগ্রামের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দুধকুমার অববাহিকার পাটেশ্বরী পয়েন্টে ১৪১ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে ধরলার পানি কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে ৪৯ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ব্রহ্মপুত্রে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে এর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে চলছে তীব্র ভাঙন। উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চর বালাডোবা, বতুয়াতলি মূসার চর, ব্যাপারীপাড়া নতুন চর এবং পূর্ব ও পশ্চিম মশালের চরের অর্ধশতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বাধ্য হয়ে এসব পরিবারের অনেকে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছেন। ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী মোল্লাহাট বাজার এলাকায় শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। বাজার রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতিতে পানিবন্দী পরিবারে খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। এ ছাড়াও দুর্গত পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’ এদিকে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে যাত্রাপুরের রলাকাটা চরে একের পর এক বসতভিটা বিলীন হচ্ছে। চরের উত্তর দিকে অব্যাহত ভাঙনে গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫ পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা বেলাল বলেন, ‘বন্যার পানি এখনো বাড়িঘরে প্রবেশ করেনি। তবে ভাঙনে এলাকার মানুষ দিশাহারা। রলাকাটার পশ্চিমে মাঝের চর ও চিড়াখাওয়ার চরের আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বাড়তে থাকলে দু-একদিনের মধ্যে বাড়িঘরে ঢুকবে।’

যাত্রাপুরের কালির আলগা ও গোয়াইলপুরির চরে গত দুই দিনে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেখানকার বেশ কিছু পরিবারের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ পরিবারের বসতবাড়ির চারপাশে পানি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা ত্রাণ সহায়তা বিতরণ অব্যাহত রেখেছি। জেলাজুড়ে চার শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আবারো পানি বৃদ্ধির ফলে যেসব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে আমরা সেদিকে বাড়তি নজর রাখছি।’

সুনামগঞ্জ: টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দ্বিতীয়বারের মতো সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঢলের পানিতে এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার ঘরবাড়ি, গ্রামীণ সড়ক ও ফসিল জমি। সে সঙ্গে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে দুই লক্ষাধিক মানুষ। অন্যদিকে ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে পৌর শহরের কাজীর পয়েন্ট, উত্তর আরপিননগর, নতুনপাড়া, হাসননগরসহ বেশ কিছু এলাকা। সে সেঙ্গে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে তাহিরপুর উপজেলা। দোয়ারাবাজার উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে সুরমা, লক্ষ্মীপুর ও বাংলাবাজারসহ তিন ইউনিয়নের। এক মাসের ব্যবধানে দুইবার সুনামগঞ্জ বন্যাকবলিত হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এই অঞ্চলের মানুষ। ভুক্তভোগীরা বলেন, কয়েক দিন আগে একদফা বন্যা হয়ে গেলেও এখন আবারো বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় আমাদের অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেছে।

তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা শাহিন মিয়া বলেন, বন্যার পানিতে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিনিয়ত পানি বাড়ছে। ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। অনেকেই আবার আশ্রয় কেন্দ্র ছোটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পৌর শহরের বাসিন্দা নাহিদ আলম বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানিতে আমাদের বেহাল অবস্থা। আমরা এই পানির হাত থেকে রক্ষা চাই। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কমলে নদীর পানি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, রাতভর নিজে উপস্থিত থেকে পৌর শহরের যে এলাকায় পানি ওঠে সেখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিষ্কার করেছি। যাতে পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, বন্যা মোকাবিলায় আমাদের সব প্রস্তুতি নেয়া আছে।

ডিমলা (নীলফামারী): নীলফামারীর ডিমলায় গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের সিকিমের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৫১.৮৫ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। পানি বৃদ্ধি পেয়ে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে নদীর তীরবর্তী এলাকা উপজেলার খগা খড়িবাড়ী, খালিশা চাপানীর বাইশপুকুর, টেপা খড়িবাড়ী, ঝুনাগাছ চাপানী, পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নসহ বেশ কিছু এলাকায়। নদীর আশপাশের পরিবারগুলো পানিবন্দীসহ কৃষি ক্ষেত তলিয়ে রয়েছে পানির নিচে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫১.৮৫ সেমি। যা বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করছে ডালিয়া পাউবো। পানি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

নালিতাবাড়ী: গত তিন দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার খরস্রোতা ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নদী তীর উপচে গিয়ে প্রবল স্রোতে বসতবাড়িতে ঢলের পানি ঢুকছে। তবে পৌর শহরের গড়কান্দা নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। গতকাল মঙ্গলবার সকালে চেল্লাখালী নদীর বারোমারী বাজার পয়েন্টে ৩১৪ সেন্টিমিটার ও ভোগাই নদীর নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ পাঠক আলমগীর হোসেন ও মুকুল মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ