বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবীতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছে দলটি। এখন দলীয় প্রধানের মুক্তির দিকেই নজর দিয়েছে তারা। এরই মধ্যে গত শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশ করেছে দলটি। এ সমাবেশে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন তাদের এ সমাবেশের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল চাপে পরেছে। এই চাপের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে চাইছে তারা। এজন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। তবে জনসম্পৃক্ত ইস্যু, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা এবং দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, মামলা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ নানামুখী তৎপরতায় তারা সরকারে চাপে রাখতে চায়।
এদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যু নিয়ে দীর্ঘ আট মাস পরে রাজপথের কর্মসূচিতে নেমেছে বিএনপি। এখন দলীয় প্রধানের মুক্তিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে তারা। এজন্য প্রথম পর্যায়ে তিন দিনের কর্মসূচি নিয়েছে দলটি। কর্মসূচির প্রথম দিন গত শনিবার (২৯ জুন) রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে সমাবেশ এবং গতকাল সোমবার (১ জুলাই) ঢাকা ছাড়া সারা দেশের মহানগরগুলোয় সমাবেশ হয়েছে। একই দাবীতে আগামী আজ ৩ জুলাই জেলা সদরে সমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে। এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে সামনে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি আসবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৪ জুন বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। বিএনপি নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে লাভ হবে না। এখন তাকে মুক্ত করার আন্দোলনে নামতে হবে। এ বৈঠকেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবীতে ও জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ২৭ জুন এক যৌথসভা শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এছাড়া জনসম্পৃক্ত ইস্যু, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা এবং দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা, মামলা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের গতি বাড়াতে চায় বিএনপি। তাই সরকারকে চাপে ফেলার জন্য বেগম জিয়া ইস্যুতে নির্বানের পর ফের রাজপথে নামার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা মনে করছেন যে, এই বিষয়টি এখন স্পর্শকাতর ইস্যু। এটি নিয়ে আন্দোলন করলে জনগণ সম্পৃক্ত হবে। দীর্ঘ আট মাস পরে সমাবেশ করলেও নেতার্কর্মীরা ব্যাপক সাড়া দিয়েছে। এ ইস্যুতে শুধু নেতাকর্মীই নয়, দেশের সাধারণ মানুষও মাঠে নেমে আসবে।
বিএনপি নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবীতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়েছে। দীর্ঘ আট মাস পরে গত শনিবার নয়াপল্টনে সমাবেশে উপস্থিতি নিয়ে শীর্ষ নেতারা খুবই সন্তুষ্ট। নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ সামনের আন্দোলনের জন্য ইতিবাচক দেখছে তারা। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের আট মাস পর এ সমাবেশে জনসমাগম বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে আশার আলো দেখিয়েছে। তারা মনে করে সমাবেশে জনসমাগমে প্রমাণ করে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য নেতাকর্মীরা যে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত রয়েছে। নয়াপল্টনে সমাবেশে সরকারকে হুঁশিয়ারী দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে সরকারের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনা করা যায় না। তাকে অন্যায়ভাবে ছয় বছর কারাগারে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। তাকে মুক্ত না করলে সরকারের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে।’ বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর বিএনপি আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। আইনি পথ অনুসরণ করেছে। কিন্তু কোথাও তারা সুফল পায়নি। এমনকি হাইকোর্টেও বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, শুধু বিএনপির নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়। শনিবার খালেদা জিয়ার মুক্তির সমাবেশে মানুষ যেভাবে উপস্থিত হয়েছে। সরকার যদি মানুষের ভাষা বোঝে তাদের যদি বোধোদয় হয় তাহলে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া উচিত। তা নাহলে সরকারের জন্য ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে। নতুনভাবে আন্দোলন শুরু হয়েছে খালেদা িজয়াকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকার প্রচুর চাপে পড়েছে। কারণ তাদের (আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা না বলে উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করেছে। এমন কোনো আইন নেই যেই আইনে খালেদা জিয়াকে আটক করে রাখতে পারে। তারা আজিজ-বেনজীরের মতো অসংখ্য দুর্নীতিবাজদের লালন-পালন করছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের তৎকালীন এক আইন মন্ত্রী বলেছেন— বিএনপিকে মামলা থেকে মুক্তি দিতে আমরা ক্ষমতায় আসিনি। এতেই বোঝা যায় তারা বিএনপিকে শেষ করে দিতে চায়। যেই মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হয়েছে; সেই সময়ে শেখ হাসিনার নামেও ১২টি মামলা ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাদের বিরুদ্ধে সব মামলা খারিজ করা হয়েছে।’ দুদু বলেন, বিএনপি প্রধানের মুক্তির দাবীতে যেই সমাবেশ করা হয়েছে এতে আমাদের শতভাগ প্রাপ্তি। এখন থেকে নতুন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন শুরু হলো। এরপর সব সাংগঠনিক বিভাগে এবং জেলা শহরে সমাবেশ করা হবে। পরবর্তীতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা আলোচনা করে আরও কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের ধারাবাহিক যাত্রা নতুন করে শুরু করেছে বিএনপি। দলীয় প্রধানের মুক্তির আন্দোলনে নেতাকর্মীদের আচরণে আমরা সন্তুষ্ট। দীর্ঘ ৮ মাস পর রাজধানীতে বড় সমাবেশ হয়েছে এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখেছি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রশ্নে নেতাকর্মীরা যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত রয়েছে। সমাবেশের দিন প্রথমে বৃষ্টি পরে গরম দুই ধরনের আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক নেতাকর্মী জমায়েত হয়েছেন। এতে বোঝা যায় তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে মাঠে থাকতে বদ্ধ পরিকর।
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশী সময় কারাবন্দী ছিলেন তিনি। ওই সময় আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী মানববন্ধন, অবস্থান, গণঅনশন, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ সমাবেশ, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। পরে করোনা মহামারীকালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাময়িক স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। কারামুক্তির পর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকছেন শারীরিকভাবে অসুস্থ খালেদা জিয়া। এর আগে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে তার পরিবার থেকে সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদন করা হলেও অনুমতি পাওয়া যায়নি। প্রতিবারই কারামুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাকে দেশে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, হূদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন।
গত ২১ জুন রাত সাড়ে ৩টার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হূদস্পন্দন অনিয়মিত হওয়ায় ২৩ জুন মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে তার হূদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়। নতুন করে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের এ অবনতিতে কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এর আগে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবীতে নানা কর্মসূচি পালন করলেও এবার শুধু তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে রাজপথে সোচ্চার হবে দলটি। বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়া পুরোপুরি মুক্ত হলে তখন পছন্দ অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ