ঢাকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

ক্রিকেট ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব

প্রকাশনার সময়: ০২ জুলাই ২০২৪, ০৯:২৬

ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা এ কথাটা আমরা বিশ্বাস করতাম। একসময় ছড়া কাটা হতো এই বলে- খেলার রাজা ক্রিকেট , রাজার খেলা পোলো....

কালক্রমে রাজা গেছেন রাজ্যও গেছে। কিন্তু খেলার রাজা ক্রিকেট বেঁচে আছে। সগৌরবে চলছে তার জয়যাত্রা। আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজদের দেয়া দুটো জিনিস আমরা অনিবার্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। রোজ সকাল সন্ধ্যায় এক কাপ চা আর খেলা মানেই এখন ক্রিকেট। কেন জানি উপমহাদেশের সবগুলো দেশই ক্রিকেট পাগল। এমন কি শ্রীলঙ্কাও। যাদের নাম বা ঐতিহ্যে পর্তুগিজীয় প্রভাব সর্বাধিক।

উপমহাদেশের ক্রিকেটে আরেকটি বিষয় ঢুকে আছে। উন্মাদনা জোশ আর পাগলামীর সঙ্গে ঢুকে গেছে তীব্র বিরোধিতা। যার আরেক নাম সাম্প্রদায়িকতা। ভারত পাকিস্তান খেলা মানেই যেন যুদ্ধ। এ দুই দেশের উত্তেজনা সমর্থকদের শান্ত রাখার কোনো পরিকল্পনা বা প্রক্রিয়াই কাজে আসে না। বরং এ যেন ছাই চাপা আগুন। কিছুদিন চাপা থাকলেও আবার দ্বিগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সে লড়াই জমেনি। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনীতি সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো তাদের ক্রিকেটের অবস্থাও নাজুক। ভারতের সঙ্গে হারাটা এখন প্রায় অভ্যাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান বিদায় নিলেও আমরা টিকে ছিলাম।

যে যাই বলুক না কেন বাংলাদেশ মাঝে মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায়। তাদের ঘুরে দাঁড়ানোটা ধারাবাহিক হতে পারলে অন্যদের খবর ছিল। এ নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা আর গালমন্দ আছে। সেটা থাকতেই পারে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ দর্শকদের মনে ভয়াবহ ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বাসা বেঁধেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশেষত ভারত জিতুক এটা কোনোভাবেই যেন মেনে নিতে পারে না। যারা এমনটি করে বা এমন ধারণা পোষণ করে তাদের সংখ্যা প্রচুর। কেন এবং কি কারণে এমন মনোভাব?

এর উত্তর দেয়া সহজ কিছু না। এর সঙ্গে দেশ জাতি অর্থনীতি দু’দেশের সম্পর্ক সবার ওপরে ধর্মীয় পরিচয় জড়িত। বিশেষত ধর্মভিত্তিক পরিচয়টাই যেন বড়। না হলে দেশের শেষ খেলায় ভালো ব্যাটিং করার পরও লিটন দাসকে গঞ্জনার শিকার হতে হবে কেন? আমি এবার আশ্চর্য হয়ে দেখলাম লেখক হিসেবে খ্যাতিমান একজন, যার লেখার পাঠক মূলত ওপার বাংলায়ই বেশী তিনি ও ভারত এবং শেষে লিটনকে অযথা এক হাত নিতে কসুর করেনি। এভাবেই সমাজের সব অংশে এখন এ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে।

২৯ জুনের ফাইনাল ছিল অসাধারণ, অবিশ্বাস্য। জিততে জিততে হেরে যাওয়া সাউথ আফ্রিকার জন্য মনটা খারাপ হতে বাধ্য। এ পরাজয় বীরের পরাজয়। হার মানা হারের এক দুর্দান্ত উদাহরণ। বিশেষ করে সূর্য কুমার যাদব যদি ওই ক্যাচটি ধরতে না পারতেন আজ বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত মহলে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত। সাপোর্ট আপনি যে কোনো দলকেই করতে পারেন কিন্তু ঘৃণা করার একটা লিমিট থাকা উচিৎ। ঘৃণা বা বিদ্বেষ কতটা গভীরে পৌঁছেছে আমার ধারণা নিচের পয়েন্টসগুলো পড়লেই তা টের পাবেন। ওর নাম সূর্য কুমার তাই ওর অসাধারণ ক্যাচটি আসলে ছয় হয়েছে। ওর নাম পান্ডিয়া তাই ওর বলগুলো নো বল হয়েছিল। ওর নাম বিরাট তাই ওর রান আসলে আইসিসি’র তোফা। কাল যে ভারত জিতেছে তার কারণ মাঠের খেলা নয় গ্যালারির সাধু সন্ন্যাসীদের দেয়া ফুঁ ও দোয়া। এ জাতীয় বিদ্বেষমূলক মনোভাব কোনো জাতি বা সমাজকে উন্নত করে না। রাজনীতি ধর্ম ও খেলা এগুলোকে আলাদা করতে না পারলে আমরা এগুতে পারব না। এটা হয়তো অস্বীকার করা যাবে না যে ভারত আনুকুল্য পায়। মাইকেল ভনের মতো নামকরা খেলোয়াড়ও এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস কি বলে? যে বছর সবাইকে তাক লাগিয়ে ভারত লর্ডসে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল সে বছরে তাদের শুরুটা কেমন ছিল? ১৯৮৩ সালে আন্ডার ডগ নামে পরিচিত কপিল দেবের ভারত যে লর্ডস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে সেটাই ভাবেনি কেউ। তাই শুরুতে সব দলগুলোকে লর্ডসের মাঠে ঢোকার পাস দেয়া হলেও ভারতকে দেয়া হয়নি। তাদের ধারণা ছিল কয়েকটা খেলার পরই গ্রুপ পর্যায় থেকে বিদায় নিতে হবে তাদের। সেবার কপিলের অলৌকিক অপরাজিত ১৭৫ রানে জিম্বাবুয়েকে হারাতে না পারলে তাই ঘটত। এমনকি ভারত যে ফাইনালে অপরাজেয় অবধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারবে তাও ভাবেনি কেউ। সে ভারত আজ কোন আসনে কিভাবে বিরাজমান তা বোঝা দরকার। এবং সেখান থেকে পাঠ নেয়া উচিৎ কোন অধ্যবসায় আর সাধনা মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যকারী প্রধান মিত্র দেশ। সময়ে জল গড়িয়েছে অনেক। অনেক বিষয়ে মতভেদ আছে আমাদের। কিন্তু এতটা ঘৃণা বা বিদ্বেষ কি যৌক্তিক? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি জানেন বৃহৎ প্রতিবেশীকে চটিয়ে লাভ হয় না বরং ছলে বলে কৌশলে তার কাছ থেকে হক আদায় করাটাই জায়েজ। খেলাতেও আমাদের এ মনোভাব থাকা জরুরী। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মান সম্মানের সঙ্গে ক্রিকেট এখন ভালোভাবে জড়িয়ে আছে। মূলত ক্রিকেট আমাদের বৈশ্বিক পরিচয়ও বটে। তাই এ জায়গায় সংযম আর ধৈর্যের বিকল্প দেখি না। বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে দুর্বলতা বা আমাদের ধারাবাহিকতার যে সংকট তা থেকে পরিত্রাণের জন্য পাশের দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সমঝোতা বা শেখার দিকটা জরুরী। শুধু তারা কেন যে কোনো দেশের ভালো খেলোয়াড় বা খেলার পাশে দাঁড়াতে পারলে আমাদের লাভ। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ব্যাপারটা ভালোভাবে জড়িয়ে। খেলোয়াড় থেকে সমর্থক সবার জন্য এটা প্রযোজ্য।

সাউথ আফ্রিকা জিতলে যেমন খুশী হতাম তেমনি মন মেজাজ ও মাথা খারাপকে উপেক্ষা করে ভারত না জিতলে বাংলাদেশী বাঙালি হিসেবে আমরাই হেরে যেতাম। অভিনন্দন টিম ইন্ডিয়া।

দুর্দান্ত ফাইনালের জন্য সাউথ আফ্রিকাকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। আমরা যেন ভুলে না যাই ক্রিকেট দিনশেষে একটি খেলা মাত্র। আর জাতিগত বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক চিরকালের বন্ধন।

লেখক: সিডনি প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ