ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘স্থবির’ হিলি স্থলবন্দর

প্রকাশনার সময়: ২৯ জুন ২০২৪, ০৯:৪৫

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্য অর্ধেকে নেমেছে। আগে প্রতিদিন পণ্যবাহী আড়াই শতাধিক ট্রাক ঢুকলেও বর্তমানে তা ৩০টিতে নেমেছে। ডলার সংকটসহ নানা জটিলতায় আমদানী কমেছে বলে দাবী আমদানীকারক ও ব্যবসায়ীদের। আমদানী কমায় দুশ্চিন্তায় আছেন শ্রমিকরা। আয় কমায় বন্দরের ব্যয়ভার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের মোট চাহিদার বেশীরভাগ পণ্য আমদানী হয় এ বন্দর দিয়ে। প্রতিদিন চাল-ডাল, পেঁয়াজ, খৈল, ভুসি, ভুট্টা ও পাথরসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী আড়াই শতাধিক ট্রাক ঢুকত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকত বন্দর। কিন্তু দিন দিন স্থবিরতা নেমে এসেছে। আমদানী কমায় আয় কমেছে শ্রমিকদের। এতে বিপাকে পড়েছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কর্মীরা। ইতোমধ্যে বন্দরের ৩৭ কর্মচারীকে ছুটিতে পাঠিয়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ ৯৭ হাজার টন পণ্য আমদানী হয়েছিল। সেখানে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গত ১১ মাসে ছয় লাখ ২৫ হাজার টন পণ্য আমদানী হয়েছে। দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে বন্দরের শ্রমিক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আগে আমদানী-রপ্তানী বেশী হওয়ায় আমাদের আয় বেশী হতো। বর্তমানে কমে যাওয়ায় আমাদের কাজ নেই বললেই চলে। এমনো দিন যাচ্ছে কোনো কাজ পাচ্ছি না। এতে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সারা দিনে ২০-২৫টি পণ্যবাহী ট্রাক ঢুকছে। যেখানে শ্রমিক আছে তিন শতাধিক। যার কারণে সবার অবস্থা খারাপ। দিন শেষে ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে জুটছে ভাগে। কোনোদিন সেটিও হচ্ছে না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি আমরা।’

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অফিসের কর্মচারী কাঞ্চন পাঠান বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের অফিসের কর্মচারী নয় জন। আগে প্রতিদিন ৩০-৪০টি ট্রাকের পণ্য খালাস করতে পারতাম। তাতে কর্মচারীদের বেতন দিয়ে অফিসের লাভ হতো। এখন সব মিলিয়ে বন্দরে ট্রাক ঢুকছে ২৫-৩০টি। এতে অফিসের আয় তো দূরের কথা কর্মচারীদের বেতন দিতেই হিমশিম খাওয়া লাগছে।’ একই কথা বলেছেন বন্দরের আমদানীকারক রিপন হোসেন। তিনি বলেন, ‘আগে আমার প্রতিষ্ঠানে ১০টির মতো এলসি খোলা হতো। বর্তমানে তা শূন্যে নেমেছে। কোনো মাসে এক-দুইটা এলসি হলেও পরের মাসে নেই। ডলার সংকটের মধ্যে এলসি খুললেও দেখা যায় বিল ছাড়তে গিয়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছে। এলসি খোলার সময় দেখি টাকার এক দাম, বিল ছাড়তে গিয়ে দেখি আরেক দাম। ফলে এলসি খুলে লোকসান হওয়ায় আমদানীকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া আমরা যেসব পণ্য আমদানী করি, একই পণ্য অন্যান্য বন্দর দিয়ে আমদানী করলে কমমূল্যে শুল্কায়নসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু হিলি দিয়ে সুবিধা তো দূরের কথা উল্টো বাড়তি মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়। ফলে আমদানীর পরিমাণ কমে গেছে।’

বন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এনামুল খান বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এখন এলসি কম খোলা হচ্ছে। এজন্য পণ্যবাহী ট্রাক কম আসছে। আবার আমদানীর ক্ষেত্রে খরচ বেশী পড়ায় আমদানীর পরিমাণও কমেছে। ফলে দুই-চার জন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাজ পেলেও অধিকাংশ এজেন্টের কাজ নেই। তারা বসে আছে। এ অবস্থায় সব মিলিয়ে এজেন্ট, মালিক, কর্মচারী ও বন্দরের শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’

কেন আমদানী কমেছে জানতে চাইলে হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জামিল হোসেন চলন্ত বলেন, ‘মূল কারণ আমদানীকারকরা চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন না। চাহিদা অনুযায়ী এলসি করতে পারলে আমদানী-রপ্তানী বাড়বে। এছাড়া বন্দরের চেকপোস্ট গেট থেকে শুরু বন্দরের গেট, চারমাথা হয়ে মহিলা কলেজ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল। চারলেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়ে অল্প কিছু এলাকায় হলেও বাকী সড়কের কাজ সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ আছে। ফলে সড়কটি দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল তো দূরের কথা মানুষ চলাচলের অনুপযোগী। আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য হলেও সড়কটির কাজ দ্রুত শেষ করা দরকার।’

বন্দরের আমদানী-রপ্তানীকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ বলেন, ‘আগে প্রতিদিন আড়াই শতাধিক ট্রাক বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করত। এখন তা অর্ধেকের নিচে নেমেছে। কারণ ডলার সংকট। ব্যাংকগুলো আমাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের এলসি খুলতে দিচ্ছে না। বিভিন্নভাবে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা থেকে নিরুৎসাহিত করছেন আমাদের। আগে দিনে শুধু পেঁয়াজ ঢুকত ৫০-৬০ ট্রাক। কিন্তু ভারত পেঁয়াজ রপ্তানীর ওপর ৪০ ভাগ শুল্ক আরোপ করায় দেশের বাজারে চাহিদা থাকলেও দাম বেশী পড়ায় আমদানী করছেন না আমদানীকারকরা। এছাড়া গোখাদ্য আমদানীও কমে গেছে। আগে শতাধিক ট্রাকে পাথর আমদানী হতো। বর্তমানে হয় না। এ ছাড়া অন্যান্য বন্দর কমমূল্যে শুল্কায়ন করলেও এখানে বাড়তি মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়। এটিও আমদানী কমার আরেকটি কারণ।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্য অব্যাহত আছে। তবে তা অর্ধেকে নেমেছে। আগে প্রতিদিন ২২০-২৩০ ট্রাকে বিভিন্ন পণ্য এলেও এখন তা ৩০টিতে নেমেছে। এতে সরকারের রাজস্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে আয়ও কমেছে বন্দর কর্তৃপক্ষের।’ আমদানী কমায় কাজ না থাকায় বন্দরের কয়েকশ শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন উল্লেখ করে সোহরাব হোসেন আরো বলেন, ‘বন্দরের দৈনন্দিন যে অবকাঠামো ব্যয়, যে ব্যাংক লোন, ইডকল লোন; এগুলো পরিশোধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়ার মতো অবস্থা নেই আমাদের। এ নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত।’

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ