ঢাকা, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

টাকার কোনো রং হয় না

প্রকাশনার সময়: ২৮ জুন ২০২৪, ০৮:৫১

সাদা টাকা ও কালো টাকা কী? এ প্রশ্নটা অনেক দিনের। কারণ টাকার রং কখনো কালো হয় না। তাহলে টাকাকে কেন কালো বলা হয়। টাকা উপার্জনের পদ্ধতিগত দিক বিবেচনায় কি টাকার রং নির্ণয় করা হয়, এটা কিন্তু সঠিক না। একটি সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, কালো টাকা হলো একটি অবৈধ লেনদেন থেকে প্রাপ্ত আয়। আবার এটাও বলা হচ্ছে যে, কালো টাকা হলো সেই উপার্জিত টাকা যার ওপর আয়কর ও অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি। কালো টাকা আর অবৈধ উপার্জন এক নাও হতে পারে। তবে জাতীয়ভাবে যা বলা হচ্ছে তাতে সব অর্থ একত্র (অবৈধ ও বৈধ) করে ফেলা হচ্ছে।

অদৃশ্য আয় বলতে বুঝানো হচ্ছে, যে আয়ের ট্যাক্স দেয়া হয় নাই। আর সব উপার্জন আবার সব সময় দৃশ্যমান নাও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে লেদ মেশিন, ট্রাক্টর ব্যবসা (ভাড়া) এক্সেভেটরের ব্যবসা এগুলো বৈধ ব্যবসা। এ রকম অনেক ব্যবসা আছে যা থেকে ব্যবসায়ীরা যে আয় করেন তা আয়করের নির্ধারিত সীমানার অতিক্রম করে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা অর্থাৎ যে টাকার ওপর আয়কর প্রযোজ্য, সেই আয়কর এ শ্রেণীর মানুষরা দেয় না।

না দেয়ার বিষয়টি জ্ঞাতসারে বা অজানার কারণও হতে পারে। তাদের উপার্জিত টাকা জমে জমে এক সময় বড় অঙ্কে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে এদের উপার্জিত টাকা কি কালো টাকা হিসেবে পরিগণিত হবে? বাংলাদেশে অবৈধভাবে উপার্জনের নানা পথ রয়েছে। চাঁদাবাজী করে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন কেউ কেউ। এ উপার্জনের ক্ষেত্রটি আয়করের নির্দেশিকা মতে কোনো ফ্রেমে ফেলা যায় না। কোন কোন উপার্জনের ওপর আয়কর দিতে হবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা আছে, চাঁদাবাজী করে অর্থ উপার্জনের ওপর কোনো আয়কর নির্ধারণ করার নিয়ম নেই। এ আয় থেকে অর্জিত টাকাটাও কালো। আজ থেকে এক বছর আগে বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পয়েন্টে, শুধুমাত্র পরিবহন সেক্টরের বিভিন্ন পরিবহন (বাস ট্রাক অটো রিকশাসহ সব যানবাহন) থেকে যে চাঁদা আদায় করা হতো তার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা। এ চাঁদার টাকাটা ক্ষমতাসীনদের পকেটেই গেছে।

এ টাকা আয় করত ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতা ও তার আত্মীয়-স্বজনরা। ভালুকা উপজেলার তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আয়ের পরিমাণটা কত? তা কি নির্ধারণ করতে পেরেছে আয়কর বিভাগ। এ চাঁদা আদায়টা আইনগতভাবে সিদ্ধ না, তাই এই ব্যক্তিদের আয়করটাও আয়কর বিভাগ নির্ধারণ করতে পারেনি। তাহলে এই কালো টাকা আর পরিশ্রম করে আয়করের সীমা অতিক্রম করা অর্জিত টাকাকে কি একসূত্রে নেয়াটা ঠিক হবে? যেমন দেশের সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ঘুষ নেয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।

আবার কোন কোন অফিসে তা ওপেন, যেমন দেশের প্রকৌশল দপ্তরগুলোতে বিল নিতে গেলে বা কাজ পেয়ে ওয়ার্ক অর্ডার নিলে দরপত্রে বর্ণিত টাকার ওপর পারসেন্টেজ দিতে হয়। এ টাকাটা প্রকৌশলীদের ব্যক্তিগত আয়। এর ফলে প্রকৌশলীরা নির্ধারিত আয় থেকে বেশী টাকা উপার্জন করেন। পারসেন্টেজ থেকে প্রাপ্ত টাকাটাও কালো। এ কালো টাকাটা কখনো দৃশ্যমান হয় না। বা এ কালো টাকা সাদা করার কোনো পদক্ষেপও প্রকৌশলীরা নেন না।

উপরন্ত যারা ভালো কাজ করেন (ঠিকাদাররা) তাদের ওপর প্রকৌশলীরা বেশী ক্ষিপ্ত হন। কারণ পারসেন্টেজের বাইরে তারা কাজ কমবেশী করিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। এ আয়গুলোর বিষয়ে কি আয়কর বিভাগ জানেন? যদি জেনে থাকেন তাহলে এ আয়ের ওপর কিভাবে আয়কর নির্ধারণ করা যায়, তার কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি তারা? প্রকৌশলীদের অর্জিত কালো টাকার কি কোনো হদিস মেলে। প্রান্তিক পর্যায়ের ঠিকাদাররা এসব প্রকৌশলীদের হাতে নানাভাবে নিগৃহিত হয়। তাই দেখা যায় অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়। বড় মাপের ঠিকাদাররা পুকুর চুরি করে প্রকৌশলীদের যোগসাজশে। বড় বড় ঠিকাদাররা ধরা পরে কিন্তু প্রকৌশলী ধরা পড়ে কম।

ডাক্তাররা চেম্বারে বসে রোগী দেখে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করে। ডাক্তারভদে ভিজিটের হার ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এক জন ডাক্তার গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-২৫টি রোগী দেখে থাকেন। হিসাব করে কি কখনো দেখা হয়েছে এদের মাসিক আয় কত? বেতন ও রোগীর ভিজিট হিসাব করে কি একজন ডাক্তার সরকারকে আয়কর দিয়ে থাকেন? প্রকৌশলী বা চিকিৎসকদের উপার্জিত টাকা সাদা না কালো? এর উত্তরটা কে দেবে।

কারণ এক জন প্রকৌশলী বা ডাক্তাররা শুধুমাত্র বেতনের হিসাবে আয়কর দিয়ে থাকেন। তাই কালো টাকার উৎস মুখ সন্ধান করাটা বেশী কষ্টসাধ্য বিষয় না। সরকারের রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ চেষ্টা করলেই বের করতে পারবেন। ভূমি রেজিস্ট্রেশন বিভাগে অলিখিতভাবে ওপেন ঘুষ প্রথা চালু আছে। দেশের প্রতিটি সাবরেস্ট্রি অফিসে, প্রত্যেকটি দলীলেই সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে টাকা দিতে হয়। যাকে সেরেস্তার খরচ হিসাবে দলীল লেখকরা নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক দলীল লেখক হিসাব করে প্রাপ্ত অর্থ অফিসে জমা দেন (এটা দলীল লেখকের পারিশ্রমিকের বাইরে)। এক জন সাব রেজিস্টারের আয় কত। এক জন সাব রেজিস্টারের তার আয়কর দেন শুধুমাত্র বেতনের টাকার ওপর। এক জন সাব রেজিস্টারও কালো টাকার মালিক। পুলিশ, কাস্টমস সহ সরকারের সব বিভাগে এ রকম ঘুষ প্রথা রয়েছে।

এ ঘুষ প্রথায় প্রচলিত অফিসগুলোতে যারা চাকরীরত তাদের কালো টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। সরকার ৩০ শতাংশ কর দেয়া সাপেক্ষে কালো টাকাকে সাদা করার পদক্ষেপ নিয়েছেন আগামী বাজেটে। তাই এ ঘুষ গ্রহণকারী সরকারী কর্মীদেরকে বলা হোক, তাদের প্রকৃত গ্রহণ করা ঘুষের হিসাব দিয়ে (মাসিক ভিত্তিতে) আয়কর প্রদান করা। এ কথাটা বাজেটে আসা দরকার ছিল। তাহলে কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে সরকারের আর বেশী রাজস্ব আদায় হতো। রাজস্ব বোর্ডের এক জন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ছেলে খাসী কেনার পড়ে যে তথ্য বেরিয়ে এলো তাতে বোঝা যায়, দেশের যে পরিমাণে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। এ দপ্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ঘুষ প্রথম সারিতে রয়েছে। এদেরকে ঘুষ দিয়ে অনেকেই সরকারের কোষাগারে তার কর্তৃক নির্ধারিত আয়কর না দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ সরকার কিছু নিরীহ মানুষের ওপর থেকে জোর করে ট্যাক্স আদায় করছেন, যেমন এমপিওভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষক, প্রান্তিক ব্যবসায়ী, সাধারণ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী।

চোরা চালানকারী, মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, চুরি, ডাকাত, নারীর দালাল, জমির দালাল, ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপকর্মকারীরা কালো টাকা উপার্জন করে। এরা উপার্জন করতে পারে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সহযোগিতা পেয়ে। বর্তমান বাজেটে তাদেরকেও সুযোগ দেয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ হারে কর প্রদান করে কালো টাকাকে সাদা করার।

এদের আয় করার কৌশলটা দৃশ্যমান না। এরা অদৃশ্যভাবে পুলিশ, প্রশাসন, কাস্টমস সহ সব বিভাগকে ম্যানেজ করে উপার্জন করে। এদের উপার্জনের সঙ্গে সরকারের প্রশাসনসহ সব দপ্তর জড়িত। পেশকৃত বাজেটে কালো টাকার নির্দিষ্টভাবে কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা হয় নাই। কালো টাকার ধরন হিসাবে এর শ্রেণীবিন্যাস করা উচিৎ। অনেকেই বলে থাকেন জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশ কালো টাকা। এ বিষয়টিও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। সরকারের উচিৎ দপ্তরভিত্তিক কর্মীদের ওপর আয়কর নির্ধারণ করা। সরকারের উচ্চ মহল ভালো করে জানেন কোন দপ্তরে কর্মরত কর্মীরা বছরে কি পরিমাণে আয় (বেতন + ঘুষ) করেন।

সেই দপ্তরের ওপর এ হিসাবের হারে করারোপ করা উচিৎ। তাহলে বাজেটে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের কথা বলা হয়েছে তার দ্বিগুণ রাজস্ব আদায় হয়ে যাবে। যেমন স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন হান্নান সাহেব। তিনি পদোন্নতি পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়েছেন। তিনি নিজ মুখে এটা স্বীকার করেছিলেন যে তার অধীনে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হবে। এ কাজ থেকে তিনি এক শতাংশ করে পারসেন্টেজ পাবেন। সেই হিসাবে হান্নান সাহেবের বার্ষিক আয় বেতন বহির্ভূতভাবে দাঁড়ায় ১ কোটি টাকা। এ রকম অসংখ্য হান্নান বাংলাদেশে রয়েছে। এ হান্নান গংদের অর্জিত আয়ের হিসাব করা দরকার। আর এদের আয়ের ওপর আয়কর ধার্য করে আদায় করতে পারলে সরকারকে বাজেটের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য ব্যাংক থেকে বা বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হবে না।

সরকারের রাজস্ব বিভাগের উচিৎ সরকারী কর্মীদের প্রকৃত আয় কত (বেতন ভাতা + ঘুষ) তা নির্ধারণ করা। এর ভিত্তিতে আয়কর আদায় করা। সাদা বা কালো টাকা হিসাবের বিষয়টি তা হলো ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ