ঢাকা, শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তিযোদ্ধা কোটা: সুবিধাবাদীদের জন্য আশীর্বাদ

প্রকাশনার সময়: ২৬ জুন ২০২৪, ১০:১০

মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়া আপনার বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা উচিত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা। এ কথাটি বিশেষ করে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। আপনি এ কোটা ছাড়া জন্মগ্রহণ করেছেন মানে জন্ম থেকেই জীবনে অর্ধেক পিছিয়ে আছেন।

আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরের লোক নই। আমি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি তাদের যারা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেননি। তাদের কথা প্রতিটি বাঙালির হূদয়ে গেঁথে আছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু, কোটা পদ্ধতি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর যথোপযুক্ত পদ্ধতি বলে আমি মনে করি না। এ কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ পরিশোধ করা খুবই নীচ কাজ এবং দেশের বর্তমান মেধাবী তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে ঘোরতর বেঈমানী। মেধাবী তরুণদের আর কত কান্না শুনতে হবে আমাদের...

ঘটনা ১: আমার অনলাইনে পরিচিত এক বন্ধু (সম্ভবত কোনো গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়) সে ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ তে ৬৪ নাম্বার পেয়েও বিষয় মনোনয়ন পায়নি। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারী একজন ৪০ নাম্বার পেয়ে ভালো একটি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে।

ঘটনা ২: আমি এডমিশন ভর্তি পরীক্ষায় যখন ময়মনসিংহ একটি মেসে থাকতাম, তখন আমার পাশের রুমে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারী এক ছেলেও ছিল। আমার রুমমেইটের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৪২ অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারী ছেলেটার জিপিএ ৪-এর নিচে ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে পাশের রুমের ছেলেটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা দেয়ার জন্য নির্বাচিত হলেও আমার রুমমেইট সেই সুযোগ পায়নি।

এরকম হাজারও ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখে আসছি। আমার দুইটি ঘটনায় আলাদা বিশেষত্ব কিছু নেই। তবে এটা বিশেষ বিষয় যে, আমি এ ঘটনা দুটির মাধ্যমে কোটার হিংস্রতা বুঝতে শিখি। আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি এই মানসিক নির্যাতনকে। সরকারী একটা চাকরী আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়। নিজেদের সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সবাই এ অর্জনটা ছুয়ে দেখতে চায়। যখন এসব কোটা এসে তাদের স্বপ্নকে পিছিয়ে নিয়ে যায় তখন বিষয়টা মেনে নেয়ার মতো না। আবার, মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীরা সবাই কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আদৌ?

যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের অনেকেই যথাযোগ্য সম্মানটুকু পাননা। ইতিহাস বলে নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব, হিন্দু-মুসলিম, ছাত্র-শ্রমিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ অশিক্ষিত, মূর্খ মানুষ যাদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে বড় হয়েছি, সমাজে তারা এখনো মূল্যহীন। তারা মানবেতর জীবন যাপন করে আসছেন। তবুও এ সাধারণ মানুষগুলোর কোনো অভিযোগ নেই। তাদের মুখে একথাও শুনেছি যে দেশে স্বাধীনের পর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিস্ট করতে এসেছিল তখন সমাজের কিছু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দৌড়াদৌড়ি করে গিয়ে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাকি নাম লেখানোর সুযোগ পাওয়াটাও তখন দুষ্কর ছিল। এগুলো আমার নিজের বানানো কথা নয়। জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করতে রণক্ষেত্রে যাওয়া একজন বীরের ভাষ্য এটা। দুর্ভাগ্যবশত তিনিও লিখিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা নন। অতিবাহিত করছেন দুর্বিষহ জীবন। তাদের কি ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার নেই? অন্যদিকে ভুয়া সার্টিফিকেট ধারী মুক্তিযোদ্ধার বংশধররা তাদের অযৌক্তিক দাবী আদায় করতে সোচ্চার হয়েছেন।

এ ছাড়াও আমি আমার হাইস্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছি যার প্রতিবেশী ভাইয়ের ছেলে-মেয়েকে সরকারী চাকরী পেতে বিশেষ সুবিধা দিতে নিজের ছেলে হিসেবে বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করেছেন। আমরা জানতে চাই এসবের শেষ কোথায়।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য নিরসনেই আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সংগ্রামে। অথচ তাদেরই ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনী স্বাধীন বাংলাদেশে বৈষম্য প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট তৎপর। তারা বাংলাদেশ সরকার ও সংবিধানের ২৯(১)নং অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের দাবী বাস্তবায়ন করছেন। সমতার বাংলাদেশে যেটা কখনোই কাম্য নয়। তবে অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠীর জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উন্নত জীবন যাপন করেছেন যারা, তারা কখনোই অনগ্রসর জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না।

সরকারী খাতায় যাদের নামের পাশে মুক্তিযোদ্ধা লেখা তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা নন। এ বিষয়টা আমরা ক্লিয়ার হয়েছি।

দেশ স্বাধীনের দীর্ঘদিন পর আধুনিক যুগে আমরা কখনোই কোটা পদ্ধতিকে সমর্থন করতে পারি না। দেশের বর্তমান প্রজন্মের জন্য এটা কখনোই কল্যাণকর হবে না। মেধাবী ও পরিশ্রমী ব্যক্তিদের বিবেচনায় রেখে দেশ ও দশের কল্যাণে তাদেরকে যথোপযুক্ত কাজে নিয়োগ প্রদানের বিকল্প হতে পারে না।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ