সরকার পতনের আন্দোলনের আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান দলে ‘সংস্কারপন্থি’ নামে বিভেদরেখা আর জিইয়ে রাখতে চাইছেন না বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এর অংশ হিসেবে ‘সংস্কারপন্থি’ নেতাদের জায়গা করে দেয়া হচ্ছে বিএনপিতে। এরই মধ্যে অন্তত এক ডজন নেতা দলে ফিরে পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ‘সংস্কারপন্থি’ আরো শতাধিক নেতাকে বিএনপিতে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে। দলে ফেরার জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ‘গ্রিন সিগন্যালে’র অপেক্ষায় রয়েছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা। সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই দলে সক্রিয় হবেন তারা। মূলত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্দলীয় সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনে তাদের সাংগঠনিক শক্তি কাজে লাগাতে চায় দলটি।
জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে তারা সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হিসেবে থাকলেও ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলে ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন তারা। কেউ কেউ আবার বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ‘বিকল্পধারা’ কিংবা কর্নেল অলি আহমেদের ‘এলডিপি’তে নাম লিখিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে এমন অর্ধশতাধিক নেতাকে দলে ফিরিয়ে নিয়েছে বিএনপি। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট সংস্কারপন্থি নেতা আবদুস সালামকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি করা হয়েছে। এ নিয়ে দলে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও দলের ঐক্যের পক্ষে থাকায় কেউ মুখ খুলছেন না। এর আগে গত ২৮ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক দলের এক স্মরণসভায় সাবেক কয়েক ছাত্রনেতা ১/১১-এর প্রসঙ্গ তুলে ‘সংস্কারপন্থি’ নেতাদের দিকে অভিযোগ তোলেন। জবাবে ওই নেতাদের হতাশার কথা না বলে দলে ঐক্য ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেন লন্ডনে থাকা নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান নয়া শতাব্দীকে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপি এখন গভীর সংকটে। তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটি ক্ষমতার বাইরে টানা ১৪ বছর। সরকারের নানা চাপের মুখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বছরের পর বছর পার করছে। এক যুগের বেশি সময় আগে ১/১১ মধ্য দিয়ে যে বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির জালে দলটি নিপতিত হয়। সেই পথ এখনো মসৃণ হয়নি। বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে টিকে রয়েছে দলটির ঐক্য। সেই ঐক্যের সূত্র ধরেই সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত শতাধিক নেতাকে আবারো গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরিয়ে এনে দলের ঐক্য মজবুত করার পথে আরো একধাপ সামনে এগিয়েছে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। তিনি বলেন, দলের একক ঐক্যের ওপর নির্ভর করে জনগণের সমর্থন নিয়ে আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়াতে প্রত্যয়ী বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সরকার পতনের আন্দোলন কীভাবে কার্যকর করা যায় তা নিয়েও এক ধরনের তৎপরতা চলছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, কেউ বিরোধিতা করলেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে দলের নীতি-নির্ধারকরা মনে করে করছেন, তারা ফিরলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে, শক্তিশালী হবে এবং আগামীতে দলের মূল নেতৃত্বের পথচলা আরো মসৃণ হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা রয়েছে, বিভিন্ন রকমের সমস্যা থাকতেই পারে তবে এখন সবাই এক হয়ে কাজ করব। দল ও জনগণের জন্য কাজ করব। দলের ঐক্য ধরে রাখব।
সূত্রমতে, ২০০৭ সালে ২৬ জুন ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং তাকে সমর্থনকারী নেতারা দলে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিতি পান। একই বছরে ৩ সেপ্টেম্বর মান্নান ভূঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তার নেতৃত্বে সংস্কারপন্থিরা রাজনৈতিক কর্মকা- চালান। এভাবেই ‘সংস্কার’ ও ‘অসংস্কারপন্থি’ দুটি ধারা তৈরি হয় বিএনপিতে। পরবর্তী সময়ে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব হলে ওই বিভেদ আরো বেড়ে যায়। কারণ তিনি ঢাকা মহানগরী কমিটি ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি সারাদেশে কমিটি গঠনের নামে সংস্কারপন্থিদের বিতাড়িত করেন। এর ফলে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নমনীয় হলেও প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ারের অনুসারীরা দলে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে সংস্কারপন্থি ইস্যু সামনে এনে দলে বিভেদ জিইয়ে রাখে। তবে ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমান দলের দায়িত্ব নেয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। তার হাত ধরে গত নির্বাচনের আগে সংস্কারপন্থি বেশিরভাগ নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
বর্তমানে সংস্কারপন্থিদের পুনর্বাসনের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে আবদুস সালামকে কমিটিতে রাখায়। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য ১/১১’র সময়ে সংস্কারপন্থিদের অন্যতম বলে পরিচিত ছিলেন। সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামকে কাজে লাগানো যাবে বলে মনে করেছেন তারেক রহমান। সাংগঠনিক এই দক্ষতার কারণেই খালেদা জিয়াও তাকে দলে জায়গা করে দিয়েছিলেন।
সালাম ছাড়াও তারেক রহমানের হাত ধরে সংস্কারপন্থি গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে গোলাম মোহম্মদ সিরাজকে বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে। দলের মনোনয়ন পেয়ে এখন তিনি সংসদ সদস্য। এ ছাড়া দলের সাবেক সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপন এখন বিএনপির গবেষণা সেল বিএনআরসির (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ সেন্টার) সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ ও নীতি-নির্ধারণী কোনো বিষয়ে ‘ড্রাফট’ বা লিখিত খসড়া তৈরিতে স্বপনের দক্ষতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ কারণেই ১/১১’র পরে দূরত্ব তৈরি হলেও শুধু কাজের দক্ষতার কারণে আবার তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন তারেক রহমান। এর বাইরে গত কাউন্সিলের পরে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ) করা হয়েছে সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সকে। শতাধিক সংসদ সদস্যের নাম সংস্কারপন্থিদের তালিকায় নাম না থাকলেও মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণেই বিএনপি একটি অংশ প্রিন্সকে ওই অংশের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে ২০০৮ সালের পরে বিএনপির মূল স্রোত থেকে প্রিন্স ছিটকে পড়েন। তবে কর্মদক্ষতার কারণে সর্বশেষ ২০১৬ সালের কাউন্সিলের পরে গঠিত কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পান প্রিন্স। বর্তমানে দলের দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাও তিনি।
সংস্কারপন্থি গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে অনেক আগেই। অসুস্থ মাহবুবুর রহমান অবশ্য এখন নিষ্ক্রিয়। যদিও সংস্কারপন্থি হওয়ায় স্থায়ী কমিটিতে জায়গা হয়নি হাফিজের। তবে সম্প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে হাফিজকে। আগামীতে তাকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হতে পারেন এমন আলোচনাও আছে। এসব নেতার বাইরে দলে পদ দিয়ে এবং সর্বশেষ নির্বাচনে মনোনয়নসহ নানা প্রক্রিয়ায় বিএনপিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে ড. ওসমান ফারুক, মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম, লুৎফুজ্জামান বাবর, আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়াম, শাহ মোহম্মদ আবু জাফর, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, নজির হোসেন, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, আসাদুল হাবিব দুলু, মাসুদ অরুণ, শামসুল আলম প্রামাণিক, রেজা আহমেদ বাচ্চু, শহিদুজ্জামান বেল্টু, নাসিরুল হক সাবু, ড. সালেক চৌধুরী, ইলেন ভুট্টো, আতাউর রহমান আঙ্গুর, ফজলে আজিমসহ অনেককে।
জানা যায়, সংস্কারপন্থি বলে পরিচিত বড় নেতাদের মধ্যে একমাত্র ডা. জিয়াউল হক মোল্লাকে সর্বশেষ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। আবার ফিরিয়ে নেয়ার পরে বিগত কয়েক বছরে এম কে আনোয়ার, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আনোয়ারুল কবির তালুকদার, রেজাউল বারী ডিনা, শহীদুল হক জামাল, আবু হেনাসহ অনেকে মারা গেছেন। মোফাজ্জল করিমকে বিএনপিতে ফিরিয়ে না নেয়া হলেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে একবার দেখা করেছেন। পাশাপাশি বিএনপির পক্ষে টক শোতে তিনি সোচ্চার।
জানতে চাইলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপির এই দুঃসময়ে সংস্কার-অসংস্কার ভাবার সময় এখন নেই। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে এটাই তো স্বাভাবিক। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের সব বিভেদ দূর করে দলকে ইতিবাচক রাজনীতির পথে নিয়েছেন। রাজপথে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই করা হচ্ছে দলের পক্ষ থেকে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে হলে শুধু বিএনপির ঐক্য নয়, জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। ফলে বিএনপিতে এখন সব ধরনের বিভেদরেখা মুছে ফেলে শুরু থেকে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, সংস্কারপন্থিদের বেশিরভাগ নেতা দলে ফিরেছেন। বাকিরাও নীতিগতভাবে দলের সঙ্গে আছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে তারাও দলে সক্রিয় হবেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আমাদের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জই হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ