ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

দেশে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে

প্রকাশনার সময়: ২২ জুন ২০২৪, ০৮:৫৪ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৪, ০৮:৫৭

এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো পেশা দুর্নীতি, চুরি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- আমলা, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর দুর্নীতি অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন অনৈতিকতা, নির্লজ্জতা, দুর্নীতির মহাউৎসব চলছে। রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তারা এবং সমাজের ধনী ব্যক্তিদের দুর্নীতি জনগণকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করছে। সমাজে দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী অসহায়ত্ব অনুভূতি অনুভব করছে। তারা বুঝতে পারছে যে, সমাজের ধনী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসন সমাজের অন্যদের দুর্নীতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করে না। আমাদের দেশে সরকারী খাত দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে সব প্রকার অনিয়মিত, অনৈতিক এবং বেআইনী লেনদেন। রাষ্ট্র বা সরকারী কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের দুর্নীতি সীমাহীন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু’র সফরে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কমিটমেন্টের ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। লু’র সফরের পরপরই ২০ মে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা জানিয়ে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে।

আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় বা থাকার পর তার আয়ের উৎস বহির্ভূত পন্থায় যে সমস্ত সম্পত্তি তৈরী করেছেন সেসব সম্পত্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে, সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশী দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। গত এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতি এবার সবচেয়ে বেশী।

বাংলাদেশে সরকারী চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ক্ষমতাশালী শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে, কেবল মধ্যম ও নিম্নসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গত ২৩ মে বেনজীর আহমেদের ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। ২৬ মে আদালত বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামের ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানীর শেয়ার ও গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই বেনজীর আহমেদ গত ৪ মে সপরিবার দেশ ছাড়েন।

তিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি এবং এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবেও দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘পুলিশের গুলিতে পুলিশ খুন’, ‘ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে পুলিশ সদস্যের আত্মহত্যা’, ‘সাবেক আইজিপি বেনজীরের স্ত্রী ও মেয়েদের সম্পত্তিও ক্রোকের নির্দেশ’— এই হচ্ছে গত এক মাসে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের বাছাই করা শিরোনাম।

বাংলাদেশ এখন দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত। দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হরিলুট চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপকহারে দুর্নীতি চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো সরকারী দপ্তর বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারী অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকার সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয়ে থাকে। ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক মজুতদারীর মাধ্যমে দ্রব্যবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, ওজনে কম দেয়া, সরকারী রেশনে কারচুপি করা, কর, শুল্ক, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেয়াসহ এ ধরনের অর্থনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলছে।

পরীক্ষায় ব্যাপক নকল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে না। এ দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করেও নানা রকমের দুর্নীতি চলছে। জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা স্বার্থসিদ্ধি, অর্থ উপার্জন বা কাজ ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের ধর্ম ব্যবসা, রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে ধোঁকাবাজি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোও ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। বেসরকারী খাতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারী সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাস-বাসন বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশী ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না করা, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারী ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঋণ খেলাপী বর্তমানে বাংলাদেশে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

রেল মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি হয় বলে মন্তব্য করেছেন রেলপথ মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুল হাকিম। তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে এ খাত এখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি। প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রীর বিদেশে ‘হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ’ নিয়ে নানা প্রশ্ন। তার ব্রিটেনে ‘হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ’ আছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার মানুষ হিসেবে তার কাছের মানুষের দ্বারা জমি ক্রয় করে অর্থ পরিশোধ না করে দখলের ভুক্তভোগী আমি নিজেই।

সাবেক ১২ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হচ্ছে শোনা যাচ্ছে, বিভিন্ন মেয়াদে যারা বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী ছিলেন এবং সরকারের ভিতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সরকারের ৫ মন্ত্রী, ৩৫ এমপি, সাবেক ১০ মন্ত্রী ও ৫০ এমপি, ৪ সিটি মেয়র, ৬ পৌর মেয়র, ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের শতাধিক, সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে প্রশাসনের শতাধিক বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, অধিপ্তরের ৩০ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৩০-৪০ সদস্যের দুর্নীতির অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের আমলকে। সেই সময় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা টাকার ভাগ নিতেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো’র দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত। পরিশেষে বলা চলে, বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিরা দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে কি দুর্নীতি, চুরি, অসততা আমাদের দেশের পেশা হয়ে উঠছে?

লেখক: কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ