ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

সেন্টমার্টিন নিয়ে অপপ্রচার কোনোভাবেই কাম্য নয়

প্রকাশনার সময়: ২১ জুন ২০২৪, ০৮:১৫

প্রায় ৯ কিলোমিটার লম্বা এবং ১/২ কিলোমিটার চওড়া সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, মৎস্য আহরণ, পর্যটনসহ নানাবিধ কারণে সেন্টমার্টিন গুরুত্বপূর্ণ। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের সাগরের তলদেশে রয়েছে মনোমুগ্ধকর বিচিত্র প্রাণী ও হরেক রকম জীব। আরো আছে নানা আকারের পাথরের স্তূপ, দুর্লভ প্রবাল, দৃষ্টিনন্দন পাথরের ফুল। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে প্রচুর চুনাপাথরসহ নানা প্রকার পাথর, রেডিয়াম, সামুদ্রিক শৈবাল, ঝিনুক, মুক্তা ও সিলিকন পাওয়া যায়।

সাগরের তলদেশে এসব বিচিত্র জীব অবাক হওয়ার মতো, দেখলে মনে হবে সাগরের তলদেশে রয়েছে স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্যময় এক জগতৎ। রূপবৈচিত্র্যের অনন্য মহিমায় রূপবতী সেন্টমার্টিন দ্বীপে চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস।

সেন্টমার্টিনের প্রায় ৭৩০০ জন স্থানীয় অধিবাসীর জীবন-জীবিকা মৎস্য আহরণ, শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ, সামান্য চাষাবাদ ও পর্যটন সেবার ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে (অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত) দ্বীপটি কর্মচঞ্চল থাকে। শতাধিক হোটেল, মোটেল রেস্তোরাঁয় চলে পর্যটক আকর্ষণের নানা আয়োজন। সন্ধ্যা বেলা হোটেল রেস্তোরাঁর সামনে পথের দু’ধারে, সৈকতের পাশে নানা পদের মাছ, কাঁকড়া, অক্টোপাসের পসার সাজিয়ে বসে দোকানীরা। তেলে ভাজা মাছের সুগন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করে। রাতে প্রায় সব হোটেলের আঙিনায় চলে মাছের বার্বিকিউ উৎসব। নাচে গানে আনন্দ আড্ডায় অপূর্ব সময় কাটে। সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ পানির জেলি ফিস, হরেক রকম সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ আর প্রবাল অন্যতম আকর্ষণ ও অপার সম্ভাবনার। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত সেন্টমার্টিনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

সবুজ শ্যামল বৃক্ষবেষ্টিত সাগর বুকে ভাসমান অনন্য শোভামণ্ডিত এই সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনের উভয় প্রান্তে ছোট বড় ৩৭টি সৈকত রয়েছে যা ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে। শীত মৌসুমে দিনে তিন থেকে চার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাচ্ছেন, রাতে থাকছেন। আয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্রবাল দ্বীপে শৈবাল সম্ভাবনা ‘সামুদ্রিক শৈবাল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। শৈবালে দুধের চেয়েও ১০ গুণ বেশী ক্যালসিয়াম রয়েছে। শৈবালেই সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশী আয়োডিন রয়েছে, যা ওষুধ বা লবণের চেয়েও সমৃদ্ধ বিকল্প হতে পারে।

বিজ্ঞানীদের দাবী, সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় ২০০ প্রজাতির জীবের উপস্থিতি রয়েছে। যার অধিকাংশ মানুষের খাদ্যসহ হাঁস-মুরগী ও মাছের খাদ্য তৈরীতে ব্যবহার করা যাবে। এই দ্বীপে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। শৈবাল বিদেশে রপ্তানী করেও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণত চার ধরনের প্রবাল সংগ্রহ করা হয় যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় পাতাফুল, গাছফুল, শৈবাল ও মগ। এদের মধ্যে গাছ ফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশী। বাহারী অলঙ্কার প্রস্তুতের জন্যই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। মাছের পাশাপাশি এই সামুদ্রিক শৈবাল চাষ এনে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা।

পরিকল্পিত বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আশার খবর হলো- সেন্টমার্টিনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন হবে সামুদ্রিক শৈবাল ভাণ্ডার। জানা গেছে, বর্তমানে ১৮০ জন চাষী ১০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ শহরের শাহ্পরীর দ্বীপ ও জালিয়াপাড়া এলাকায় নাফ নদীর তীর এবং উখিয়ার ইনানী এলাকার রেজু খালের তীরে শৈবাল চাষ করছেন। এসব চাষী বছরে দু’টি প্রজাতির ৪০০ থেকে ৫০০ মণ শৈবাল উৎপাদন করছে। অনেক চাষী প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত আরো প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার মণ শৈবাল সংগ্রহ করছে। চাষকৃত ও সংগৃহীত এসব শৈবাল শুকিয়ে ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে বিক্রী করা হচ্ছে। এসব শৈবাল মিয়ানমার থেকে চলে যাচ্ছে চীনে। বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, সামুদ্রিক শৈবালে ওষুধি গুণাগুণ রয়েছে।

তাই এগুলো ওষুধ কারখানায় এবং জৈব সার তৈরীতে বিভিন্ন দেশে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। প্রয়োজন ইকো-ট্যুরিজম এ দ্বীপে ভ্রমণে এসে যেন যে কেউ প্রকৃতির পরশে শিহরিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি পরিকল্পনায় রেখে অবকাঠামোসহ সব স্থাপনার নির্মাণশৈলী ও উপাদান হবে প্রাকৃতিক। এ লক্ষ্যে স্থানীয় জনবসতিসহ সরকারী-বেসরকারী স্থাপনাও গড়ে তুলতে হবে ইকো-ট্যুরিজমের আওতায়। এর ফলে যান্ত্রিক জীবনে অতিষ্ঠ মানুষ প্রকৃতির পরশ নিতে ছুটে আসবে সেন্টমার্টিনে।

পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেন্টমার্টিনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অবর্ণনীয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ খাত প্রবল সম্ভাবনাময় এই সেন্টমার্টিন নিয়ে একটা বিশেষ মহল প্রতিদিন চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিগত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ এবং কিছু মদদপুষ্ট গণমাধ্যম মিয়ানমারের পতাকা সম্বলিত নৌযানের কিছু ছবি বেশ ফলাওভাবে প্রচার করছে। সঙ্গে রাখছে মুখরোচক শিরোনাম এবং মনগড়া তথ্য। বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবেই তারা বলছে বাংলাদেশের সীমানায় মিয়ানমারের হানা! আদতে এর সত্যতা কতটুকু? মিয়ানমারের সীমান্তে থাকা জাহাজের ছবি তুলে জনবিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সরব কুচক্রীমহল কোন উদ্দেশ্যে এ মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে? জনমনে আতঙ্ক তৈরী করতে নাকি কুচক্রী মহলের এখানে আলাদা কোনো লক্ষ্য নিহিত আছে সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। কোনো একটি দেশের জলসীমা লঙ্ঘন করা এতটা সহজ নয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর যদি আঘাত আসেও, তা দমন করতে সর্বদা প্রস্তুত সরকার ও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী।

সেন্টমার্টিন নিয়ে যা চলছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার বৈ আর কিছু নয়। সেন্টমার্টিন সব সময় বাংলাদেশের ছিল, আছে এবং থাকবে। এটা নিয়ে একটা কুচক্রী মহলের অপতৎপরতা মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে ঘোলাটে করে বিশেষ কোনো ফায়দা লুটার অপপ্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে অপপ্রচারকারী এবং অপপ্রচারে বিশ্বাসী সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, আমরা ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। এত এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ কী এত সহজেই বিলীন হয়ে যাবে? কখনোই না। ১৯৭১ সালে এত এত অপপ্রচেষ্টার পরেও বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে যেমন মুছে দিতে পারেনি। ঠিক তেমনি এখনো বাংলাদেশকে নিয়ে যতই অপপ্রচার করা হোক না কেন তাতে কিছুই হবে না।

বরং অপপ্রচারকারীদের মুখে কালি লেপন করে বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষা করবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সাময়িক যে পরিস্থিতির তৈরী হয়েছে তাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কঠোর নজরদারী রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শেখ হাসিনার সরকার সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে। কারো সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য নয় বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে।

যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসবে এ ধরনের কোনো সুযোগই নেই। সেই ক্ষেত্রে যারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তারা তাতে কোনোভাবেই সফল হতে পারবে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ অবস্থাকে অপপ্রচারের মাধ্যমে বিনষ্ট করার সুযোগ কোনোদিনও বঙ্গবন্ধুকন্যা কুচক্রী মহলকে দেবে না। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা রক্ষার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর সংকল্পবদ্ধ।

এমতাবস্থায়, অপপ্রচারকারীদের উচিত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে নিয়ে সব ধরনের অপপ্রচার ও চক্রান্ত থেকে বিরত থাকা। সামুদ্রিক সম্পদ এবং পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় সেন্টমার্টিন নিয়ে অপপ্রচার করে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে ঘোলাটে না করা। এরপরেও সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে অপপ্রচারের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলায় তা কখনোই কাম্য হবে না। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অদম্য সাহসী সোনার ছেলেরা ১৯৭১ সালের ন্যায় সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে অপপ্রচারকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত। কারণ বাঙালিরা সব কিছু সহ্য করলেও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত বা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র বা অপপ্রচার সহ্য করবে না।

বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত। আমাদের বিশ্বাস ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যেমন বাঙালিরা এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে এসেছিল। তেমনি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো ধরনের আঘাত এলে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা কঠোরভাবে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে অপপ্রচারকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দেয়া হবে।

লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ