ঢাকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

বাজেট সমাচার

প্রকাশনার সময়: ২০ জুন ২০২৪, ০৮:৩৪

দেশের ৫৩ তম প্রস্তাবিত বাজেট (অর্থবছর ২০২৪-২৫) দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশন উপস্থাপন করেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটটি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশী।

বাজেটে আয়ের খাত হলো রাজস্ব আদায় হবে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি। আর বাকী দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পূরণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থার যে বেহাল গতি আছে তা সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে। এ দুরাবস্থায় ব্যাংক খাত থাকার পর অভ্যন্তরীণ অর্থ বাজার থেকে সরকার বড় অঙ্কের অর্থ ঋণ নিলে ব্যাংক বাজারের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশী।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, উন্নত দেশগুলোর সরকার নাকি এর চেয়ে বেশী অর্থ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে নিয়ে থাকে। উন্নত দেশের ব্যাংক বা অর্থ বাজেটের কি পরিমাণ অর্থ ঘূর্ণায়মান তার একটি হিসাব এবং বাংলাদেশের ব্যাংক ও অর্থ বাজারে ঘূর্ণায়মান অর্থের একটি তুলনা চিত্র অর্থমন্ত্রী যদি তুলে ধরতেন তাহলে বোঝা যেত আসলে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়াটা যৌক্তিক। কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে তারল্য সংকট মারাত্মক। দেশের বহু ব্যাংকের শাখাগুলো তাদের আমানতকারীর জমা করা অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। বর্তমানে দেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা। এর ফলে দেশের ব্যাংকগুলোর বিরাট অঙ্কের অর্থ স্থবির হয়ে পড়ে আছে। এই ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী দেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে ১ লাখ ৮২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ছয় মাসে ব্যাংক খেলাপী বেড়েছে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ঋণের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেলাপী ঋণের পরিমাণ। অপরদিকে ব্যাংক তার উদ্ধৃত্তপত্রে দেখানো হয় না বছরের পর বছর পরে থাকা খেলাপী ঋণের পরিমাণ। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা খেলাপী ঋণকে বলা হয় অবলোপনকৃত ঋণ।

প্রতি বছরই বাড়ছে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদনের অনুসারে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৭৯০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে আদায় হয়েছে ২৫৪ কোটি টাকা। যা পুরো ঋণের ১৪ শতাংশ। ব্যাংক সেক্টরে বর্তমানে যে বেহাল অবস্থা পড়েছে। এ সংকটকালে ব্যাংক সেক্টর থেকে সরকারের এত বড় অঙ্কের ঋণ নেয়াটা অর্থনীতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। তাছাড়া সরকারের রাজস্ব খাত থেকে আয় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এই বাড়ানোর পরিমাণটা হবে গত অর্থ বছরের চেয়ে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা বেশী। এই বেশী রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে সরকার কিছু খাতে অধিক করারোপ করেছেন। এ করারোপটা অনেকটা মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো। মোবাইল ফোন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নিত্য ব্যবহার্য একটি উপকরণ। মোবাইল ব্যবহারের কর বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাজেটে। এ প্রক্রিয়ায় সরকার তার রাজস্ব আদায় ঠিকই করতে পারবে। কিন্তু বাজ পড়ার মতো অবস্থা হবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। এ করারোপের কারণে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালীতে দেখা দেবে ছেদ চিহ্ন। কারণ সাধারণ মানুষের আয় বাড়ার কোনো নিশানা নাই।

প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫টি খাতে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। খাত ভিত্তিক বরাদ্দ হলো, জনপ্রশাসন খাতে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ২২ শতাংশ। স্বাধীন দেশের ৫৩তম বাজেটে আমলা পোষার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এ বরাদ্দ আনুপাতিক হারে ব্রিটিশ আমলেও আমলাদের জন্য ব্যয় করা হয়নি। ব্রিটিশরা আমলা দিয়ে এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করত তারপরও এত বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হতো না আমলাদের বেতন ভাতা ও সুযোগ সুবিধা খাতে। যা বর্তমানে করা হচ্ছে। দেশের জনপ্রশাসন মূলত দেশের মানুষকে শাসনের নামে শাসায়। আমলাদের শাসনের পদ্ধতিগত কারণে পড়ে দেশের জনপ্রতিনিধিরা কাঠের পুতুলে পরিণত হচ্ছে। দেশে এত সংখ্যক আমলা কেন রাখা হয়েছে, তারও একটা ব্যাখ্যা দরকার কারণ এদের পুষতে গিয়ে বাজেটের প্রায় এক চতুর্থাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়। এ বিষয়টিরও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জনসম্মুখে আসা প্রয়োজন। যেহেতু দেশে সরকারী পাটকলগুলো লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চাকরীচ্যুত করা হয়েছে লাখ লাখ শ্রমিককে। দেশের ঋণ প্রতিদিন বাড়ছে, বর্তমানে রাষ্ট্রের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টাকা। রাষ্ট্র যে ঋণ করে তার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ চলে যায় আমলা পুষতে, সুতরাং দেশের মানুষরে ঋণের বোঝা কমানোর লক্ষে আমলা ছাঁটাই করাটা অতীব জরুরী। এই আমলারা দেশের কি কি উন্নয়ন ঘটিয়েছে তার একটি চিত্রও উপস্থাপন করা দরকার। দেশে জনপ্রশাসন শাসনের নামে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে আর স্তব্ধ করছে বাকস্বাধীনতা। জনপ্রশাসন খাত একটি অনুৎপাদনশীল খাত এটি উৎপাদন খাতগুলোর একটি সহায়তার জন্য কাজ করার কথা। অথচ এতেই বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে সব মূল খাতের চেয়ে বেশী। দেশের জননিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বিডিআর, দেশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী এরা আন্তর্জাতিক মিশনে গিয়ে দেশের জন্য রেমিট্যান্স আনছে, অপরদিকে আমলা বিদেশ সফরের নামে দেশের অর্থ বিদেশে দিয়ে আসছে।

২০২৪-২৫ বাজেটের অপর খাতগুলোর বরাদ্দের মাঝে, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন খাতে ৪৭ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা, প্রতিরক্ষা খাতে ৪২ হাজার ১৪ কোটি টাকা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৩৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে এক লাখ ১১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতের বরাদ্দের একটি অংশ চলে যায় ক্যাডেট খাতে (সেনাবাহিনীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খরচ), স্বাস্থ্য খাতে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৪৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, গৃহায়ন খাতে ছয় হাজার ৯২৯ কোটি টাকা, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে ব্যয় ৮২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। একটি বরাদ্দের বিষয়টি আমলে আনা উচিৎ, তা হলো সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ খাত।

বিষয়টি লক্ষণীয় কারণ দেশের যে পরিমাণে ঋণ রয়েছে সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে ব্যয় হয় এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রতি বছরই ঋণ বাড়ছে অপরদিকে বাড়ছে সুদের পরিমাণ। তাই ঋণ নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরী। কারণ যে পরিমাণ টাকা ঋণের সুদ পরিশোধ করতে দিতে হয় তার জন্য জনগণ কোনো ফল পায় না। বাজেটের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে তাই বাজেটের কিছু খাতের ব্যয় কমানো দরকার, যে খাতগুলো দিয়ে রাষ্ট্রের কোনো উৎপাদন হয় না, সেই খাতগুলোতে ব্যয় কমানো এবং কর্মী সংকোচন নীতি গ্রহণ করা জরুরী। দেশের ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে আর এই ঋণের বোঝা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে টানতে হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে ভালো থাকার জন্য এখনই সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার অর্থাৎ ঋণের লাগাম টানা উচিৎ। এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটে অন্যান্য খাতে আট হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

বাজেটে কিছু পণ্যের দাম কমানোর কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে খাদ্য পণ্য অন্যতম। দেশের খাদ্য পণ্যের ৮০ শতাংশই কৃষক উৎপাদন করে। ধান, চাল, দেশজ ফলমূল, শাক সবজীর দাম কমানো হলে কৃষকের আয় কমে যাবে। দেশের প্রায় ৫৮ মতাংশ মানুষ কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে কৃষি পণ্যের দাম কমালে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দেবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সুতরাং এ বিষয়টিও সরকারের দেখা উচিৎ। দেশের অর্থনীতিকে হুমকীর সম্মুখীন করছে যে বিষয়গুলো তার মধ্যে অন্যতম হলো— ঋণ খেলাপী, প্রশাসনিক ব্যয় ও অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ। এ তিনটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য সরকারের নতুন করে ভাবা দরকার। এ তিনটি বিষয়ের জন্য দিন দিন দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থায় সংকট বাড়ছে। আর্থিক সংকটের কারণে দেখা দিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। সুতরাং অর্থ মন্ত্রনালয়কে বিষয়গুলো নিরিখে নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, দেশের সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ