ঢাকা, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১০ রজব ১৪৪৬

সাম্যের বাণী নিয়ে আসে পবিত্র ঈদ-উল আজহা

প্রকাশনার সময়: ১৬ জুন ২০২৪, ০৮:৫৮

পৃথিবীজুড়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন উৎসব আছে। উৎসব জাতিগত ঐক্যের চেতনা সৃষ্টি করে। উৎসবের দিনগুলোও যে কোনো জাতির স্বাতন্ত্র্র্য ও পৃথক পরিচয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও প্রতীক। একটি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয় সত্তা নির্মাণ করতে, তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করতে সম্মিলিত আনন্দ ও উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঈদ শব্দটিতে জড়িয়ে আছে এক অপূর্ব আনন্দ শিহরণ।

শব্দটি নিমেষেই পরিবেশের আবহ বদলে দেয়। সব অভাব অনটন দুঃখ বেদনা সরিয়ে অদৃশ্য এক আনন্দ অনুভবে মন ভরিয়ে দেয়। মুসলিম জীবনাচারে ঈদ পেছনে ফেলে আসা আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দে উদ্বেল করে তোলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। আত্মীয় পরিজন, শৈশবের বন্ধু, সবার সঙ্গে ঈদ আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবাইকে ঘরমুখী ও শেকড়মুখী করে তোলে। নাড়ীর অবিচ্ছেদ্য টান- যেন প্রাণ ফিরে পায়- ঈদ এলেই। প্রবাসের দুঃখ বেদনা যন্ত্রণা সব পেছনে ফেলে তাই তো মানুষ অনেক কষ্ট করে হলেও ছুটে যায় আপনজনের মাঝে। পথের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট আমলে না নিয়েই সবাই ফিরতে চায় ফেলে আসা শত সহস্র স্মৃতিবিজড়িত শৈশবের পরিবেশে, আত্মীয় পরিজন এবং বন্ধুদের মাঝে।

এ এক অপার্থিব আনন্দক্ষণ। হাজার বছর ধরে চলে আসা এক ধারাবাহিকতা। মুসলিম জীবনাচারের সাংস্কৃতিক ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ ঈদ এবং ঈদ আনন্দ। হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে চলে আসা এ ধারাবাহিকতায় এখনো ঈদের ছুটি, ঈদ যাত্রার সরলীকরণ করা যায়নি, বিশেষ করে আমাদের দেশে। প্রতি বছরই পুনঃপৌনিকভাবে একটা সমস্যা এ আনন্দকে প্রায়ই বিষাদে পরিণত করে। তা হচ্ছে ঈদের ছুটি বিন্যাস। অথচ মুসলিম জীবনে অসীম গুরুত্ব আর তাৎপর্যময় উৎসব ঈদ-উল আজহা। আত্মত্যাগ ও ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার দিন।

ঈদ উৎসবটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি ইসলামে ধর্ম আর জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।

সুতরাং মুসলিম জীবনে ঈদ কেবল বিলাসিতা কিংবা স্রেফ আনন্দ উপভোগেরই নাম নয়। এতে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব বোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এলাকার লোকেরা ঈদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সবার মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে। ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী-গরীবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী-গরীব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদ-উল আজহায় যে কোরবানী দেয়া হয়, তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানীর রক্ত-মাংস কখনোই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। শুধু দেখা হয়, মানুষের হূদয়কে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হূদয়ের পরিচয়। পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন।

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে হযরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন প্রিয়তম বস্তু তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করার জন্য। সেই অনুযায়ী তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয়পুত্রকে কোরবানী দিতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে আর শেষ পর্যন্ত পুত্রকে কোরবানী দিতে হয়নি। ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানী হয় একটি পশু। মহান আল্লাহর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হযরত ইবরাহিম (আ.)। এ সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমাকে তুলে ধরাই ঈদ-উল আজহার পশু কোরবানীর প্রধান মর্মবাণী।

সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক, মুকিম ব্যক্তিই ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নেসাব (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সেই পরিমাণ নগদ অর্থ) পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তবে তার ওপর কোরবানী করা ওয়াজিব। কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য জাকাতের নেসাবের মতো সম্পদের এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং যে অবস্থায় সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়, ওই অবস্থায় কোরবানীও ওয়াজিব হবে। কোরবানীর অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন ও ত্যাগ ইত্যাদি। কোরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ -এ তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবেহ করাই হলো কোরবানী। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই কোরবানীর তাৎপর্য। অতএব, আমাদের একান্ত কর্তব্য, খাঁটি নিয়ত সহকারে কোরবানী করা এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জন করা।

নিজেদের আনন্দে অন্যদের শরীক করা ঈদ-উল আজহার শিক্ষা। কোরবানীকৃত পশুর গোশত তিন অংশে ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ, দ্বিতীয় অংশ আত্মীয়-স্বজনকে প্রদান এবং তৃতীয় অংশ সমাজের অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া ইসলামের বিধান। কোরবানীকৃত পশুর চামড়া অনাথ আশ্রম, এতিমখানা ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের জন্য প্রদান করলে বিবিধ সওয়াব হাসিল হয়। এক দুঃখী মানুষের সাহায্য দ্বিতীয় দ্বীনি শিক্ষার বিকাশ। প্রকৃতপক্ষে কোরবানীদাতা কেবল পশুর গলায় ছুরি চালায় না; বরং সে তো ছুরি চালায় সব প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে। এটিই কোরবানীর মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তি। কোরবানীর ঈদ বা ঈদ-উল আজহা আমাদের কাছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতি বছর উপস্থিত হয়।

ঈদ-উল আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সব পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার ও রিপুর তাড়না বা শয়তানের অসওয়াসা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হবো। পবিত্র ঈদ-উল আজহা প্রতি বছর আমাদের কাছে ঘুরে ফিরে আসে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পশু কোরবানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা করে। এ কোরবানীর শিক্ষা কী, তা আমাদের জানা দরকার। মনে রাখতে হবে, কোরবানী শুধু পশু জবেহ করা নয়, কোরবানী হলো নিজের ভিতরের পশু সত্তাকে জবেহ করা। তার মানে মনের সব কুপ্রবৃত্তিকে খতম করা। কোরবানীর গোশত পেয়ে গরীব-দুঃখী খুশী হয়। কোরবানী করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য ও নির্দেশ মানার শিক্ষা গ্রহণ করে। কোরবানীর দিন মুসলমানরা একে অপরের সঙ্গে মহামিলনে মিলিত হয়। এদিন ধনী-গরীব কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এতে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরী হয়। তাই কোরবানী যাবতীয় আহকাম মেনে খোদাভীতির মানসিকতা নিয়ে কোরবানী করা দরকার। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহর দরবারে আমাদের কোরবানী কবুল হবে। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সামর্থ্য হবো। সুতরাং, ঈদ-উল আজহা কেবল পশু কোরবানী করা এবং আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বুঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ, নিজের ভিতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি। উল্লেখ্য, ঈমান আনয়নের মাধ্যমে সবাই মুমিন বা মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ঈমান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি মুমিন ইসলামের সব বিষয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। সুখ দুঃখ এবং সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় ইসলামই একমাত্র অনুশাসন একথাটি নিজের মধ্যে দৃঢ় করে নেয়া।

প্রকৃত মুমিনের মৌলিক চিন্তা চেতনা এমন হওয়াটাই কাম্য। ঈদ মুসলিম এবং প্রতিটি মুমিনের হূদয়ে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অনন্য মাধ্যম। ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ নিষেধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশী- এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদ-উল ফিতর বা ঈদ-উল আজহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি ক’জনই বা গুরুত্ব দিচ্ছি। ঈদ যেমনি আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন মানসিকতা বিসর্জন দেয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায় নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার।

শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার। তাই আসুন ঈদ-উল আজহার প্রকৃত মহত্ত্ব ও তাৎপর্য নিজে লালন করতে শিখি। অসুন্দর ও কলুষিত হূদয় পবিত্র করার লক্ষ্যে ঈদ-উল আজহায় শিক্ষা গ্রহণ করি। তাই ঈদ-উল আজহার পশু কোরবানীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকেই কোরবানী দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কোরবানীর মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। আমরা চাই ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সব অনিশ্চয়তা শঙ্কা দূর হোক।

হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একসঙ্গে এক কাতারে পবিত্র ঈদ-উল আজহার আনন্দে শামিল হয়ে সবার মধ্যে সাম্য ও সহমর্মিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলি। মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে আমাদের প্রার্থনা হোক- জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকারের হিংসা বিদ্বেষ ও হানাহানি মুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক হাসি খুশী ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। সবাইকে ঈদ-উল আজহার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন— ঈদ মোবারক।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ