ঢাকা, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১০ রজব ১৪৪৬

আমানত ভেঙে খাচ্ছেন অনেকেই

প্রকাশনার সময়: ১৫ জুন ২০২৪, ০৮:৪৪

ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট থাকলেও বাড়ছে আমানত। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে আমানত। তবে উল্টো পথে হাঁটছে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত কমেছে। যার পরিমাণ ৫২৫ কোটি টাকা। সঙ্গে কমেছে আমানতকারীর সংখ্যাও। এ তিন মাসে ৩ হাজার ৯০০ আমানতকারী কমেছে। অন্যদিকে গত এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৫৯ হাজারেরও বেশী। এর আগে টানা নয় মাস এ খাতে আমানত ইতিবাচক ধারায় ছিল। এনবিএফআই খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তারা অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয়ায় এ সংকট তৈরী হয়েছে। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে, যা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে মানুষের। ফলে আমানত ভেঙে খাচ্ছেন অনেকেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, মার্চ প্রান্তিক শেষে এনবিএফআই খাতে বকেয়া আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় ১.৩৭ শতাংশ কম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক খাতে যেখানে এখন ৯-১০ শতাংশ হারে আমানত বাড়ছে, সেখানে এনবিএফআই খাতে আমানত কমে যাচ্ছে। এ খাতটিতে একটা সময় প্রচুর অনিয়ম হয়েছে। বেশ কিছু এনবিএফআইয়ে এ ক্লাসিফাইড ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি।

তিনি বলেন, এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। তাই গ্রাহকরা নতুন করে আমানত করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অল্পকিছু এনবিএফআই ভালো পারফর্ম করছে, তবে মূল্যস্ফীতির কারণে তারাও খুব বেশী আমানত বাড়াতে পারছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চ প্রান্তিকে এনবিএফআই খাতের ফিক্সড ডিপোজিট কমার কারণেই সার্বিক আমানত কমে গেছে। তিন মাসে এ খাতে ফিক্সড ডিপোজিট কমেছে ৫৯৭ কোটি টাকা। খাতওয়ারী শ্রেণীবিভাগ বলছে, বেসরকারী খাতও এসব আমানত তুলে নিয়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানী লিমিটেড-এর (বিডি ফাইন্যান্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কায়সার হামিদ বলেন, আস্থার ঘাটতির যে কথা বলা হয়, সেটি পুরোনো সমস্যা। তিনি বলেন, এর মধ্যেও বেশ কিছু এনবিএফআই ভালো পারফর্ম করছে। ফলে আস্থা না থাকায় আমানত কমেছে— এ কথা বলা যাবে না। মূলত দুটি কারণে এনবিএফআই খাতে আমানত কমেছে উল্লেখ করে কায়সার হামিদ বলেন, প্রথমত, বর্তমানে আমরা আমানত নেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২.৫৫ শতাংশ সুদ দিতে পারছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া ক্যাপের কারণে রেটটা বাড়ানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংক ও সরকার তাদের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক ব্যাংক ১৩ শতাংশ সুদহার দিচ্ছে। সরকারের ট্রেজারী বিল ও বন্ডের সুদহার রয়েছে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ। ফলে গ্রাহকরা আমানত করার ক্ষেত্রে এনবিএফআইয়ের চেয়ে ব্যাংক বা ট্রেজারী বিল ও বন্ডই বেশী পছন্দ করছে বলে জানান তিনি।

কায়সার হামিদ বলেন, দ্বিতীয়ত, আমরা দেখছি ছোট আমানতকারী যারা আছেন, তাদের অনেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির কারণেই এসব আমানত কমছে বলে আমরা ধারণা করছি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমানতের পাশাপাশি গ্রাহকও হারাচ্ছে এনবিএফআইগুলো। বছরের প্রথম তিন মাসে এনবিএফআই ৩ হাজার ৮৮০টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। মার্চ শেষে এ খাতে ৪.২৭ লাখ ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আমানত কমলেও ঋণ বেড়েছে এনবিএফআই খাতে। মার্চ শেষে এ খাতের বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ১.০৪ শতাংশ বা ৭৭০ কোটি টাকা বেশী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির খেলাপী ঋণের হার ৫০ শতাংশের বেশী। সবগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপী ঋণ ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা ১৭টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।

গত বছর ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে মোট আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩১ হাজার ২২১, যা চলতি বছর মার্চ মাস শেষে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৪১। এর মানে গত তিন মাসের ব্যবধানে খাতটিতে সার্বিক আমানকারীর সংখ্যা কমেছে ৩ হাজার ৮৮০। তবে এ তিন মাসে মহিলা আমানতকারী হিসাব সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে, এর পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৪৯০টি। আর পুরুষ আমানতকারীর হিসাব না কমে উল্টো ৪২৮টি বেড়েছে। অন্যদিকে এ সময়ে পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী হিসাব কমেছে ১ হাজার ৮২৫টি। আর মহিলা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী হিসাব কমেছে ৩টি। ২০২৩ সালের মার্চে এ খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৫৫৪টি। এদিক থেকে গত এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে মোট আমানতকারী হিসাব কমেছে ৫৯ হাজার ২১৩টি। এর মধ্যে পুরুষ আমানতকারী হিসাব কমেছে ৪১ হাজার ৯৩০টি। আর মহিলা আমানতকারী হিসাব কমেছে ১৭ হাজার ৫৮৫টি। একই সময়ে পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী সংখ্যা কমেছে ৮৩৭টি। তবে এ সময়ে মহিলা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ১৩৯টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন খেলাপীরা টাকা ফেরত না দিলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই আচরণ দেখা যাচ্ছে। এখানেও পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশে নামে-বেনামে ঋণের টাকা তছরুপ করে পালিয়ে গেছেন। ফলে এ খাতের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও সন্দেহ বেড়েছে, টাকা রাখলে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা এ ভয় ঢুকে গেছে। এর মধ্যেই আমানতের সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সীমা দেয়ায় গ্রাহকরা আরো নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ