ঈদ-উল আজহার আগে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আংশিক কমিটি বাড়ানোর কথা থাকলেও ‘বিস্ফোরণের’ ভয়ে তা থেমে গেছে। তবে ঈদের পরে চলতি মাসের মধ্যেই কমিটি দেয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে দেয়া হবে তা অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে কমিটি প্রস্তুত করা হয়েছে, সেটি সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীরা।
ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, চলমান আন্দোলন সংগ্রামে যারা নিজেদের জীবনবাজী রেখে দলের কর্মসূচী সফল করেছে কমিটিতে তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। ২৮ অক্টোবর থেকে যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে সংগঠন তাদের প্রতি উদারতা দেখাবে। কর্মসূচী বাস্তবায়নে কারা রাজপথে ছিল এবং কারা ছিল না এসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় যাদের নেতৃত্বে কর্মসূচী বাস্তবায়ন হয়েছে তাদের কাছ থেকে সক্রিয় ছিলেন এমন ব্যক্তিদের বায়ডাটা নেয়া হয়েছে।
গত ১ মার্চ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের ৭ সদস্য বিশিষ্ট নতুন আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন। রাকিবুল ইসলাম বাকিবকে সভাপতি ও নাছির উদ্দীন নাছিরকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, শ্যামল মালুমকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আমানউল্লাহ আমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক, মো. জাহাঙ্গীর আলমকে দপ্তর সম্পাদক এবং শরিফ প্রধান শুভকে প্রচার সম্পাদক করা হয়। সূত্রে জানায়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আংশিক কমিটি চূড়ান্ত করেছে সংগঠনটি। ঈদুল আজহার আগেই তা ঘোষণা করা কথা ছিল, কিন্তু কমিটিতে যারা পদবঞ্চিত হবেন তারা আন্দোলন করতে পারেন এমন আশঙ্কা রয়েছে। যার কারণে ঈদের আগে কমিটি না দিয়ে চলতি মাসের শেষদিকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে যখনই কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তখন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা আন্দোলন করেছেন। এমনকি নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরও করেছেন।
ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সেক্রেটারি রবিউল ইসলাম নয়ন পর্দার অন্তরাল থেকে ছাত্রদলের কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা কমিটিতে কে কোন পদে আসবেন সে বিষয়ে প্রভাব খাটাচ্ছেন দলের ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের ঘনিষ্ঠ রবিউল ইসলাম নয়ম। এছাড়া ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও ঢাকা মহানগর পূর্বের কমিটিতেও নিজের পছন্দের লোকদের নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্রদল সূত্র জানায়, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আংশিক কমিটিতে দুইশতের অধিক পদপ্রত্যাশীদের পদায়ন করা হবে। এবারের কমিটিতে ১৫ থেকে ২০ জন নারী জায়গা পাবেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশী প্রাধান্য দেয়া হলেও এবার রাজপথের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের মূল্যায়ন করা হবে। একই সঙ্গে ঢাকার চার মহানগরেও নতুন আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, ঢাকা মহানগর পূর্ব ও ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে— কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়া হয়। লবিং এবং তদবিরের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই কেন্দ্রীয় পদ ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হয় ঢাবিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পদেও তাদেরকে পদায়ন করা হয়। অন্যদিকে রাজধানীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের কর্মীদের রাজপথের ত্যাগ ও পরিশ্রম অনুযায়ী কম মূল্যায়ন করা হয় এমনকি ভালো পদে পদায়ন হতেও বঞ্চিত হতে হয় তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদপ্রত্যাশী এক নেতা বলেন, কমিটি গঠন একটা নিয়মতান্ত্রিক ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। কমিটি ঈদের আগে বা পরে কোনো বিষয় নয়। ছাত্রদল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন। সবাই চায় নেতৃত্বে আসতে। কিন্তু সবাইকে তো জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। কেউ না কেউই তো বাদ যাবে। সুতরাং কমিটি ঈদের পরে দিলেই যে সবাই খুশি হবে তা নয়। আমার মনে হয় কমিটি দিয়ে দেয়াই ভালো। সর্বোপরি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত যা মেনে নিতে প্রস্তুত ছাত্রদলের নেতাকর্মীর। তিনি বলেন, যোগ্য ও ত্যাগীরাই নেতৃত্বে আসুক এটাই চাই। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মেধার পাশাপাশি বিগত আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে ও মিছিল-মিটিংয়ে অবস্থান, মামলা, জেল-জুলুমকেই বিবেচনায় আনা উচিত। তাহলেই সংগঠন শক্তিশালী হবে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক এক সভাপতি বলেন, গত ২৮ অক্টোবরের পর সরকারবিরোধী চূড়ান্ত কর্মসূচী দিয়ে মাঠে ছিল বিএনপি। এ সময় যারা কর্মসূচী সফল করতে রাজপথে থাকতে পারেনি তারা আর কবে থাকতে পারবে। নিজেদের জীবন বাজী রেখে সাবেক যেসব নেতাকর্মী মাঠে ছিলেন তাদেরকেও মূল্যায়ন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। যারা মাঠে ছিলেন তাদেরকে দিয়েই কমিটি দেয়া হবে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির সভাপতি— সাধারণ সম্পাদক এমন বক্তব্য দিচ্ছেন। যদি সেই ভাবে কমিটি দেয়া হয় তাহলে ভালোই হবে। কিন্তু তাদের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল না থাকলে সেটা ভালো হবে না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কমিটিতে বেশী প্রাধান্য দেয়া হয়, কিন্তু অন্যান্য ইউনিটের যারা মাঠে থেকে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তাদেরকেও মূল্যায়ন করা উচিত; তাহলে সংগঠনের ভারসাম্য রক্ষাপাবে।
এ বিষয়ে জানতে ছাত্র দলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫ জন এবং একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে ৩০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট শ্রাবণকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে রাশেদ ইকবাল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। এ সময়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে অভ্যন্তরীণ নানা অনিয়ম একাধিকবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। বিএনপির একদফার আন্দোলনে ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও অন্যরা মাঝে মধ্যে মিছিল করলেও দেখা মেলেনি সাধারণ সম্পাদক জুয়েলের, যা তৃণমূল নেতাকর্মীদের হতাশ করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত দিনে বিএনপির বেশিরভাগ আন্দোলনে ছাত্রদল অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পর লাগাতার হরতাল-অবরোধে রাজপথে খুব বেশী শক্তি দেখাতে পারেনি সংগঠনটি। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি গ্রুপ কর্মসূচী পালন করলেও শীর্ষ নেতাদের নিস্ক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্বাচনের পর বিএনপির সার্বিক মূল্যায়নে এ দুর্বলতাগুলো উঠে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ছাত্রদলের আগের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে ছাত্রদলের কমিটি গঠনে সিন্ডিকেট ও আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকায় ত্যাগী-পরীক্ষিতরা বঞ্চিত হয়েছেন। আন্দোলনেও এর প্রভাব পড়েছে। এবার কোনো সিন্ডিকেট না থাকলেও নতুন কমিটি গঠনে ছাত্রদলের সাবেক কয়েকজন নেতা প্রভাব বিস্তার করেছেন।
সূত্র জানায়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শক্তিমত্তায় ভর করেই বিএনপি বরাবর প্রতিরোধ কর্মসূচী দিয়ে এসেছে। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারী আত্মপ্রকাশের পর থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংগঠনটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় থেকেছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রসংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি এখন অনেকটাই নিস্ক্রিয়। এ অবস্থার জন্য মূলত দলটির নেতাদের ব্যর্থতাই দায়ী। সংকট উত্তরণ এবং জনগণের স্বার্থে যথাসময়ের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্রদল। অতীতে ছাত্রদলের কমিটি দেয়ার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট-আঞ্চলিকতা প্রভাব ছিল বলে অভিযোগ ছিল। যে কারণে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা সিটকে পড়েন। তবে এবারের কমিটি ‘মাইম্যান’ থেকে বের হতে না পারলে আগের থেকে খারাপ অবস্থায় পড়বে ছাত্রদল এমন আশঙ্কা অনেকের।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ