ঢাকা, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১০ রজব ১৪৪৬

চারপাশ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে

প্রকাশনার সময়: ১৪ জুন ২০২৪, ০৮:৪৭

জীবনের বয়স বহু বছর। সময় চলে যায় দিন গুনে গুনে। নদীর স্রোতের মতো আর ফিরে না, ফিরে আসে না। চাইলেই শৈশব বা কৈশোরে আর ফিরে যেতে পারব না, ফেরার নেই কোনো সম্ভাবনা। স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুময় দিনগুলো আর কোনো দিন ফিরবে না। আড্ডাগুলো আবার বটতলায় হাটতলায় বসবে না, বসলেও আগের মতো আর জমবে না।

জীবন এখন করপোরেট অফিসগুলোর মতো চার দেয়ালের ভিতরে আটকা পড়ে ছটফট করছে। কালের স্রোতে ভাসতে গিয়ে সামাজিক সম্পর্কের যোগাযোগটা আমরা সামাজিক মাধ্যমে নিয়ে গেছি। আগের সেই চিঠি, পত্র মিতালী, ডাক বাক্স, ডাক পিয়ন এসব এখন অতীত ইতিহাস। চারিদিকে কৃত্রিম একটা সম্পর্কের হা হুতাশ। লোক দেখানো প্রতিযোগিতা, সম্পদ গড়ার বা ভোগ বিলাসে মত্ত হওয়ার এক অনিয়মতান্ত্রিক ব্যস্ততা আমাদের সম্পর্কগুলোকে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। সামাজিক সম্পর্কগুলোতে পুরোনো সেই সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা, মিষ্টি মুখরতা, নান্দনিকতা, ঘনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা নাই বললেই চলে। লোক দেখানো হাই, হ্যালো দিয়ে সম্পর্কের মিষ্টতা রক্ষার বৃথা চেষ্টা হরহামেশাই চোখে পড়ে। সে কারণেই সম্পর্কগুলো তার স্বাভাবিক দিক যেমন পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্কের মিষ্টতা, উদারতা ও সহনশীলতা এসব হারাতে বসেছে।

ইদানীং জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা মানুষের মনে কাজ করে। বাইরে বের হলে ঘরে সুস্থ শরীরে ফিরতে পারবে কি না সেই শঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আছে প্রত্যেকটি মানুষের মনের গভীরে। সামাজিক নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তার বলয়টা যেন একেবারেই অরক্ষিত।

বর্তমান সমাজ ও বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয় সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা, নৈতিক জ্ঞান এবং ধর্মীয় শিক্ষার অভাব তথা অতি আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা এবং সমাজ থেকে উদারতা, সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, মানবিকতা, মানবতা বোধের চর্চা উঠে যাওয়াই এর কারণ। সেই সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহমর্মিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ঢুকে গেছে। ক্ষমতার মোহ, ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতা, ক্ষমতার দাপট, ক্ষমতার প্রভাব, বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বেড়েছে। এতে কিন্তু বিশেষ একটা শ্রেণী বা গোষ্ঠী বা একক কোনো ব্যক্তি লাভবান হয়েছে বা হচ্ছে। আমি বা আমরা যারা আমজনতা তারা দিনের পর দিন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি একচেটিয়া।

সামাজিক ন্যায় বিচার, আইনের শাসনের অভাব এখন প্রকট। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে না, ব্যক্তির অঙ্গুলি নির্দেশে চলে-এমন অভিযোগ এখন প্রকাশ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। অনিয়ম, অনাচার এবং ব্যভিচারে এ সমাজ এখন বেশ কলুষিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আদালত হলো বিবেক। বিবেক যখন লোপ পায় তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, দানব হয়ে ওঠে, দানবের মতো আচরণ করে। এ সমাজের অধিকাংশ মানুষই এখন কদর্য, নিচ, হিংসাত্মক, সহিংস প্রকৃতির। তারা আক্রমণাত্মক এবং নীতি ভ্রষ্টতায় আচ্ছন্ন। এরাই কিন্তু সমাজের নিয়ন্ত্রক ও প্রভাবশালী বলে চিহ্নিত ও পরিগণিত। ফলশ্রুতিতে পরিচ্ছন্ন মানসিকতার লোক বিশেষ করে গুণীজনরা সমাজে অবহেলিত ও উপেক্ষিত।

বিপরীত দিকে যদি বলি, তাহলে বলতে হয় বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এখন আর সমাজের বিবেক নয়। অনেকে এখন বুদ্ধি বিক্রী করে অর্থবিত্ত এবং সামাজিক মান মর্যাদার অধিকারী হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে, রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে দলভিত্তিক ধান্দাবাজে পরিণত হয়েছে। এতে সমাজের উপকারের বদলে অপকারের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।

সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এ সমাজকে আরো বেশী সহিংস করে তুলছে। যেসব মূল্যবোধ ব্যক্তি সমাজের কাছ থেকে আশা করে এবং সমাজ ব্যক্তির কাছ থেকে লাভ করে সেগুলোই সামাজিক মূল্যবোধ। যেমন- বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, সামাজিক শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, দানশীলতা, শ্রমের মর্যাদা, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা গুণাবলীগুলোই সামাজিক মূল্যবোধ। সমাজে এগুলোর অভাব এখন প্রকট। যার অব্যবহিত ফল হলো সামাজিক অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও অসহিষ্ণুতা, পরনিন্দা, পরচর্চা। যার নেতিবাচক প্রভাব সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

নীতি ও উচিত-অনুচিত বোধ হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস। নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব মনোভাব এবং আচরণ যা মানুষ সব সময় ভালো, কল্যাণকর ও অপরিহার্য বিবেচনা করে মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করে। নীতি ও উচিত-অনুচিত বোধের দিক থেকেও এ সমাজ চরম অবক্ষয়ের দিকে। পরস্পরকে সম্মান দিয়ে কথা বলা, আস্থায় নেয়া, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, সহনশীল আচরণ প্রকাশ আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিমণ্ডল থেকে একদম উঠে গেছে। আগামী প্রজন্ম কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে, আমরা কোন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য তাদেরকে তৈরী করছি, কোন সমাজে তারা বেড়ে উঠছে, তাদের চিন্তা ভাবনা ও ধ্যান ধারণায় কেন আত্মকেন্দ্রিকতা দিনের পর দিন প্রকট হয়ে উঠছে এসব নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। আমরা সহিংস, নাকি অহিংস বাংলাদেশ গড়ব, নীতি বিবর্জিত একটি আগামী প্রজন্ম তৈরী করে যাব, নাকি সুখী সমৃদ্ধ একটি সুস্থ ও সৃজনশীল এবং নৈতিক ও মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সৃষ্টিশীল ও কর্মমুখর জনসম্পদ তৈরী করব যাদের দ্বারা দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি সমৃদ্ধ হবে, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকবে তেমন প্রজন্ম সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেব? সেটা ভাবতে হবে, ভাবার সময় এসেছে।

দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, গত দুই দশকে দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নও সাধিত হয়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে সরকারী হিসাব বলছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে বলে সরকার দাবী করছে। তাহলে সমাজ থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা প্রায় বিলুপ্ত যাচ্ছে কেন? কেন তারা ওএমএস এর চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণের জন্য হতদরিদ্র মানুষের লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছে? সমাজবিদরা বলছেন এ সমাজে এখন দুটো শ্রেণীর অবস্থান যথা উচ্চবিত্ত তথা ধণিক শ্রেণী আর নিম্ন শ্রেণী তথা হতদরিদ্র বা গরীব শ্রেণী। মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণী এক সময় যারা রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ও চালিকাশক্তি ছিল তারাও এখন আর আগের মতো সচল নেই এ সমাজে। এ সমাজে অর্থ ও জীবনযাত্রার মানের বৈষম্যটা আকাশ সমান ব্যবধানে এসে দাঁড়িয়েছে।

রাজনীতির প্রতি উচ্চ ধারণা পোষণ করায় ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। উদ্দেশ্য- গঠনমূলক রাজনীতি করা, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা, আদর্শবাদী রাজনীতির ধারক বাহক হওয়া, দেশের সেবা করা, জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলা, জনগণের পাশে থাকা। কলেজ জীবন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বিশেষ করে নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের একজন সৈনিক হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে যুক্তও ছিলাম। রাজনীতি করতে গিয়ে বিরোধী পক্ষের মামলাও খেয়েছি। যখন পুলিশ বাসায় হানা দিল তখন মনে হলো জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যখন দেখলাম দলের পরিবর্তে বাবাকেই মামলার সব খরচ বহন করতে হচ্ছে, দল কোনো দায় নিচ্ছে না তখন রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়াটাই যৌক্তিক মনে হলো। আন্দোলনের মুখে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হলো। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচিত হলো। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র পেলাম না। পেলাম দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার এক স্বৈরতন্ত্র। নতুন ধারার এ স্বৈরতন্ত্র আমাদের গণতন্ত্রের বারোটা বাজাল, নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারগুলো অনেকটাই কেড়ে নিল, দেশে বিভাজনের রাজনীতি শুরু করল, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করল। বাকস্বাধীনতা হরণের প্রক্রিয়া শুরু হলো, তার জন্য বিভিন্ন প্রকার অগণতান্ত্রিক নীতি ও আইন-কানুন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো, দেশেবিরোধী মত ও দলের প্রতি দমন পীড়নের মাত্রা অতিরিক্ত হারে বাড়তে শুরু করল। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হলো, জনস্বার্থে কাজ করার পরিবর্তে প্রশাসনসহ প্রতিটি সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেল। রাজনীতিবিদরা পরস্পর বিদ্বেষী হয়ে উঠলো। হিংসা, বিভেদ ও হানাহানি এবং পরনিন্দা ও পরচর্চায় অভ্যস্ত হতে শুরু করলো। পর্যায়ক্রমে জাতীয় রাজনীতি সহিংস হয়ে উঠল। যার প্রভাবে রাজনীতি এখন ভয়াবহভাবে কলুষিত এবং নোংরা কুটচালে ব্যতিব্যস্ত।

তাই মানুষ এখন আর রাজনীতি নিয়ে ভাবে না। ভাবতে চায়ও না। ভেবে কী লাভ? রাজনীতি তো তাদের কিচ্ছু দিচ্ছে না। জনসাধারণের অভিমত- রাজনীতি তার আদর্শিক অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। অর্থাৎ জনসেবার পরিবর্তে এটা ব্যবসার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সম্পদ আহরণ, সম্পদ অর্জন ও গড়ার হাতিয়ারে রূপ নিয়েছে। এ ব্যবসায় তো কোনো অর্থ লগ্নি করতে হয় না। মোটামুটি একটু ক্ষমতা, প্রভাব, দাপট, থাকলেই সে নেতা। এর থেকে আমাদের পরিত্রান কী মিলবে না?

লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতি ও উন্নয়ন বিভাগ, ইউডা

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ