ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

করপোরেট বাণিজ্যের থাবা পশুর হাটে

প্রকাশনার সময়: ১৪ জুন ২০২৪, ০৮:৩৭

দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদ-উল আজহা। মহান সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে এবং তাঁর নৈকট্য লাভের আশায় এ দিনে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, দুম্বা, উট ইত্যাদি পশু ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী কোরবানী করে থাকেন। তাই কোরবানীর পশু কিনতে কেউ যাচ্ছেন হাটে, কেউবা ছুটছেন খামারগুলোতে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীর হাটগুলোতে চলছে গরু কেনাবেচা।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে হাটে গিয়ে গরু কেনার পরিবর্তে খামারমুখী হচ্ছেন বেশীর ভাগ মানুষ। হাট বসার আগেই ক্রেতারা বিভিন্ন খামার ঘুরে ঘুরে তার পছন্দের গরুটি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ ওজনে কিনছেন, কেউ দরদাম করে কিনছেন। আবার অনেক ক্রেতা আগেভাগেই ‘প্রি বুকিং’ এর মাধ্যমে কিনে রাখছেন কোরবানীর পশু। যাতে ঈদের আগের দিন এসে তারা গরুটি নিয়ে যেতে পারেন। আর এর জন্য বাড়তি কোনো খরচও নিচ্ছেন না খামারীরা। কিন্তু কোরবানীর পশু কিনতে হঠাৎ কেন ক্রেতারা হাটের পরিবর্তে খামারমুখী হচ্ছেন? কেনই-বা দিন দিন খামারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ক্রেতাদের?

কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর কোরবানীদাতাদের অধিকাংশের বাড়িতেই গরু রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এ ছাড়াও কোরবানীর গরুকে খাওয়ানো আর যত্ম নেয়ারও সুযোগ নেই নগরবাসীর। অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে গরু কিনলে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত বিনা খরচে গরু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন ক্রেতারা। তাছাড়া খামার থেকে গরু কিনলে ক্রেতারা ওজন মেপে নিশ্চিত হয়েই নিতে পারছেন।

অন্যদিকে হাটের ভিড়, অতিরিক্ত হাসিল আদায়, পশু পরিবহনের খরচ আর শহরের বাড়িতে কোরবানীর গরু-ছাগল রাখার ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে হাটের চেয়ে খামার থেকেই গরু কিনতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন সাধারণ ক্রেতারা। তারা বলছেন হাটে প্রচুর ভিড় থাকে, ফলে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাছাড়া হাটে দালালের খপ্পরেও পড়তে হয় অনেককে। তারা কমিশন চায়, হয়রানী করে। তাই এসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পশু কিনতে আগ্রহী নন তারা। আর এ কারণে খামারকেই কোরবানীর পশু ক্রয়ের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিচ্ছেন তারা।

আবার বিভিন্ন অ্যাগ্রোর মালিকরা মনে করছেন, ভবিষ্যতেও মানুষ খামারমুখীই হবে। কারণ বাজারে যে গরুগুলো বিক্রীর জন্য আনা হয় তাতে অনেক সময় ইনজেকশন দেয়া হয়। অনেকেই পশু কিনে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কিন্তু তারা খামারে রাখা গরুগুলোকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে থাকে। তাছাড়া ক্রেতারাও খামারে এসে নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন গরুকে কি ধরনের খাবার দেয়া হচ্ছে। তাই ক্রেতাদের খামারের প্রতি আস্থা ও আগ্রহ তৈরী হয়েছে। তাদের প্রত্যাশা ক্রেতারা যেন সব সময়ই খামারমুখী হন।

এদিকে কোরবানীর পশু কেনার ক্ষেত্রে দিন দিন খামারের জনপ্রিয়তা বাড়লেও, এক্ষেত্রে ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ফার্ম সিন্ডিকেটের কারণে অনেক ক্রেতা গরু পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত দাম চাওয়ার কারণে কিনে নিয়ে যেতে পারছেন না। তাদের অভিযোগ কোরবানীর ঈদকে লক্ষ্য করে সিন্ডিকেট চক্র কম দামে গরু নিয়ে মজুদ করে রাখে। ঈদ এলে ক্রেতাদের কাছে অতিরিক্ত দাম চেয়ে বসে। ফলে ক্রেতারা লাগামহীন দাম শুনে ফিরে যাচ্ছে।

গরু-ছাগলের দাম বেশী হওয়ার কারণ হিসেবে কোনো কোনো বিক্রেতা দাবী করেছেন, তাদের গরু-ছাগল নাকি উচ্চ বংশের! তাই এত দাম চাওয়া হচ্ছে। আর এ উচ্চ বংশের গরু কিনতে উচ্চ শ্রেণীর মানুষরাও বেশ আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। নিজেদের অবস্থা প্রতিপত্তি দেখাতেই তারা এত দাম দিয়ে গরু ক্রয় করছেন আর সেই সুযোগে খামারীরাও গরুর বাহারী নামের ছলে চড়া দাম হাঁকাচ্ছেন।

সমাজে দামী গরু কেনার এই যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও লোক দেখানো মানসিকতা, সেটিরই সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট মহল। এক কোটি টাকা দিয়ে গরু কেনার কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও, অনেক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সেই গরুটি কেনার জন্য রয়েছে অতি আগ্রহ। আর এভাবেই সমাজে একটা সময়ে এসে তৈরী হয়েছে পশুর দাম ও আকার নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ফলে সাধারণ ক্রেতারা এখন চাইলেও ছয় ডিজিটের নিচে মূল্যের কোনো গরু কিনতে পারেন না। কিন্তু অনেকে আবার ঠিকই ন্যায্য মূল্যের চেয়ে বেশী দাম দিয়ে গরুটি ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে একদিকে যেমন করপোরেট বাণিজ্যের সুযোগ তৈরী হচ্ছে তেমনই সমাজেও তৈরী হচ্ছে শ্রেণী বৈষম্য। করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে পুরো বিষয়টি। পশুপালন ব্যয় বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে এ সিন্ডিকেট চক্র। দেশের গো-খাদ্য থেকে শুরু করে গবাদী পশুর প্রজনন ব্যবস্থা সবই এখন করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে।

তবে এমন অনেক চিত্রও দেখা যাচ্ছে যে, বেশী দাম হওয়ায় বড় গরুগুলো খামারে অবিক্রীতই রয়ে যাচ্ছে। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কোরবানী দেয়া সম্ভব নয় বলে গরু না কিনে ছাগল কিনেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এ ধরনের সিন্ডিকেট থাকা সত্ত্বেও দেশী গরু কেনার আশায়, হাটে দালাল অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগী এবং হাসিলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে খামার থেকেই কোরবানীর পশু ক্রয়ের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ