ঢাকা, সোমবার, ১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ জিলহজ ১৪৪৫

মিন্টুর মুখে রাঘব বোয়ালদের নাম!

প্রকাশনার সময়: ১৪ জুন ২০২৪, ০৮:২৬

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় আটক ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে ৮ দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে মঙ্গলবার বিকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি মুখ খুলছিলেন না।

পরবর্তীতে প্রযুক্তিগত তথ্য-প্রমাণ হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর এক পর্যায়ে সব কিছু স্বীকার করে গোয়েন্দাদের আদ্যপান্ত জানান। এছাড়া রিমান্ডে থাকা গ্যাস বাবুও মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য দেন। এরপর মিন্টুকে আনারের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। মূলত ঝিনাইদহ-৪ আসনে এমপির হওয়ার লোভে পড়ে নেপথ্যে থাকার একটি বড় শক্তির ইন্ধনে তিনি এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বলে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। তার হয়ে কাজ করেন রিমান্ডে থাকা জেলার আরেক নেতা গ্যাস বাবু। বাস্তবায়নে ছিলেন কোটচাঁদপুরের আখতারুজ্জামান শাহীন ও চরমপন্থী নেতা আমান উল্লাহ ওরফে শিমুল ভূইয়া এবং তার সঙ্গীরা।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, খুনের মূল কারণ স্বর্ণ চোরাচালান ও হন্ডি ব্যবসা। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ঝিনাইদহ জেলার দুই প্রান্তে অবস্থিত দুটি জেলার সাবেক এমপি এবং একই এলাকার প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে চোরাচালানের টাকার ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন আনার। সম্প্রতি দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এ কারণে তারা আনারকে সরিয়ে দেয়ার পথ খুঁজছিলেন। এক পর্যায়ে এই সিন্ডিকেটের নজরে পড়ে আনারের সঙ্গে জেলা সেক্রেটারি মিন্টুর দ্বন্দ্বের বিষয়টি। তারা মিন্টুকে আনারের আসনে এমপি বানানোর লোভ দেখান। মিন্টুও তাদের ফাঁদে পা দেন। দফায় দফায় তাদের সঙ্গে মিন্টুর বৈঠক হয়। এক পর্যায়ে খুনের দায়িত্ব নেন মিন্টু। গোয়েন্দা ওই কর্মকর্তার মতে, মূলত চোরাচালানের দ্বন্দ্ব হলেও খুনে ব্যবহার হয়েছে রাজনৈতিক শত্রুতা। এতে ফায়দা লুটেছেন ওই চোরাচালন সিন্ডিকেট।

সূত্র মতে, আনারকে খুনের দায়িত্ব নেয়ার পর কোদচাঁদপুরের শাহীনের সঙ্গে ঢাকায় দেখা করেন মিন্টু। কারণ শাহীনের স্বর্ণ চোরাচালানের একটি বড় অঙ্কের টাকা মেরে দিয়েছিল আনার। এ কারণে আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল শহীনেরও। শাহীনকে বলা হয় আনার সরে গেলে মহেশপুর সীমান্তের দায়িত্ব দেয়া হবে তাকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গ্যাস বাবুও। শাহীনও লোভ পড়ে ও পূর্ব শত্রুতার কারণে রাজী হয়ে যান। এরপর চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বেশ কয়েক বছর আগে এই শিমুল ভূইয়ার বোন জামাই টুটুল ডাক্তার ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হন।

শিমুলের ধারণা ছিল ওই ঘটনায় আনারের হাত রয়েছে। এ কারণে আনার খুনের অফার লুফে নেন শিমুল ভূইয়া। চুক্তি হয় পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে শিমুল এই খুন করবে। অগ্রিম দেয়া হয় দুই কোটি। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর মিন্টুর পক্ষ হয়ে শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন গ্যাস বাবু। আর শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিল শাহীন। সব কিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর শাহীন ও শিমুল যান কলকাতায় বাসা ভাড়া করতে। কিন্তু সেখানে ফ্যামিলা ছাড়া বাসা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তারা শেলাস্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কলকাতায় ডেকে নেন। সেখানে শেলাস্তিকে শাহীনের বউ হিসেবে উপস্থাপন করে বাসা ভাড়া করা হয়। পরে এই শেলাস্তির মাধ্যমে আনারকে হ্যানি ট্রাপে ফেলে কলকাতায় ডেকে নেয়া হয়। আনার কলকাতায় যাওয়ার পর আগে থেকেই শিমুলের নেতৃত্বে ৬ খুনি ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে আনারকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন শেলাস্তি। সেখানে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে অজ্ঞান করে আনারকে একটি চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়। পরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার পর লাশ টুকরা করে গুম করে খুনিরা। এরপর শাহীনের কাছে আনারের নিথর দেহের ছবি পাঠান শিমুল। শাহীন ওই ছবি পাঠান গ্যাস বাবুর কাছে। এরপর চুক্তি অনুযায়ী বাকী টাকা চাওয়া হয়। পরবর্তীতে গ্যাস বাবু ওই ছবি পাঠান মিন্টুর কাছে। টাকা দেয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয় ২৩ মে। এরই মাঝে আনার খুনের ঘটনা প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে সবাই আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু মিন্টু ও গ্যাস বাবু প্রকাশ্যে ছিল। এমনকি তারা আনারের বাসায় সান্ত্বনাও দিতে গিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে মূল খুনি শিমুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর গ্যাস বাবুর ৩টি মোবাইল নিয়ে নেন মিন্টু। পরে মোবাইলগুলো হারিয়ে গিয়েছে মর্মে থানায় জিডি করেন গ্যাস বাবু। এরপর শিমুলের জবানবন্দিতে মিন্টু ও গ্যাস বাবুর নাম চলে আসার পর পর্যায়ক্রমে দুই জনকেই গ্রেপ্তার করা হয়।

সূত্র মতে, আনার খুনে কাটআউট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গোয়েন্দা দুই ধাপ পার করেছেন। বাকী ধাপে কারা জড়িত রয়েছেন তাও তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মিন্টু অর্থদাতা কিনা জানতে চাওয়া হবে: ডিবি প্রধান

ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অর্থদাতা ও নির্দেশদাতা ছিলেন কি না তা তদন্তে বের করা হবে। তদন্তে সুস্পষ্ট অভিযোগ না পেলে আমরা কাউকে ডাকি না। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, কিলার শিমুল ভূঁইয়া ও গ্যাস বাবুর জবানবন্দিতে কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। এ কারণে মিন্টুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাকে ব্যাপক আকারে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সেই কারণে আমরা তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করি। পরে মিন্টুর ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

ডিবি প্রধান বলেন, সাইদুল করিম মিন্টুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে তিনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কতটুকু জানেন। গ্যাস বাবুর মোবাইল কেন নেয়া হলো সেটিও জিজ্ঞেস করা হবে। কিলার শিমুল ভূঁইয়া ঢাকায় আসার পর কেন মিন্টুর প্রতিনিধি গ্যাস বাবু তার সঙ্গে দেখা করলেন, জানতে চাওয়া হবে মিন্টুর কাছে। টাকা-পয়সার লেনদেন সঠিক কিনা? গ্যাস বাবুর মোবাইল নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন কিনা? এছাড়া আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা? সব কিছু মিন্টুর কাছে জানতে চাওয়া হবে বলে জানান হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু রিমান্ডে রয়েছেন। গ্যাস বাবু স্বীকার করেছেন, আনার হত্যাকাণ্ডের মূল ঘাতকের সঙ্গে মিটিং এবং একাধিকবার দেখা করেছেন তিনি। আক্তারুজ্জামান শাহীনের পক্ষে কাজ করেছেন শিমুল ভূঁইয়া, অন্যদিকে সাইদুল করিম মিন্টুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন গ্যাস বাবু।

গ্যাস বাবুর যে মোবাইল হারানোর কথা বলা হচ্ছে। মোবাইলগুলো মিন্টু নিয়েছেন কিনা? জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, গ্যাস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রথমে জানিয়েছিলেন মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় তিনি জিডি করেছেন। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, মিন্টুর বুদ্ধিতে মোবাইল মিন্টুর কাছে দিয়ে তিনি থানায় হারানোর জিডি করেন। হারুন বলেন, গ্যাস বাবু ও সাইদুল করিম মিন্টুকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে আমরা বিস্তারিত পরে জানাবো। প্রয়োজনবোধে আবারও শিমুল ভূঁইয়াকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

৮ দিনের রিমান্ডে মিন্টু: এদিকে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন তার এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মঙ্গলবার (১১ জুন) বিকেলে ধানমন্ডি থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এর আগে গত ২৩ মে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও শেলাস্তি রহমানকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দুই দফায় তাদের ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তারা তিনজনই ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ১২ মে ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে নিখোঁজ হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। পরে তাকে হত্যার খবর আসে। এঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের স্বীকারোক্তি অনুসারে কিছু হাড় ও মাংস খণ্ড উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো আনারের কিনা তার ফরেনসিক পরীক্ষা চলছে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ