ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের (সাধারণ ও কারিগরী শিক্ষা) স্কুল ‘ছায়াতল বাংলাদেশ’-এর নবম শ্রেণীর ছাত্রী বর্ষা আক্তার, বয়স ১৯। মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লার পোড়াবস্তিতে রিকশা চালক বাবা আর বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করা মায়ের সঙ্গে বাস করে বর্ষা। দারিদ্র্যতা, ক্ষুধা, নিরাপত্তাহীনতা যেখানে নিত্যদিনের সঙ্গী সেখানে আগ্রহ থাকলেও স্কুলে যাওয়া হয়নি তার।
চঞ্চল প্রকৃতির শিশু বর্ষা ১০ বছর বয়সেও রাজধানী ঢাকার শ্যামলী পার্কে ঘুরে ঘুরে বোতল কুড়াত। পার্কে আসা মানুষদের কাছে ঝাল মুড়ি, ফুচকা-চটপটি খাওয়ার আবদার করত। শিক্ষা নেই, কোনো উৎসব নেই, এভাবেই চলছিল শিশু বর্ষার দিন। একদিন পার্কে ঘুরতে আসা পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ছায়াতল বাংলাদেশ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সোহেল রানা’র নজরে আসেন বর্ষা। তিনি বর্ষাকে ‘ছায়াতল বাংলাদেশ’ স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন।
সেই থেকে বর্ষা এখানকার শিক্ষার্থী। স্কুলটির মূল বৈশিষ্ট্য- শিক্ষাদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বই-খাতা, স্কুল ড্রেস, স্কুল ব্যাগ, শীতের সোয়েটার এমনকি সকাল ও দুপুরের খাবারও দেয়া হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলে ব্যতিক্রমী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পড়াশোনার পাশাপাশি বর্ষা হ্যান্ডিক্রাফট, সেলাই মেশিন চালানো, মোবাইল সার্ভিসিং, কম্পিউটার শিক্ষায় দক্ষ হয়ে উঠছে। নৃত্য শিক্ষার প্রশিক্ষণও নিচ্ছে। সে এখন স্বপ্ন দেখে, খুব দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে মা-বাবার সব দুঃখ-কষ্ট মুছে দিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর।
শুধু বর্ষা, নিশান বা হাসানই নয় কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে জায়গা করে নিচ্ছে দেশের শত শত সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়ে।
বেকারত্ব দূরীকরণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরী, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থসামাজিক উন্নয়নে কারিগরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োগ ঘটানোই কারিগরী শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
১৯৬০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, একাডেমিক কার্যক্রমের তদারকীকরণ এবং কারিগরী শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা অধিদপ্তরের মূল কাজ। অধিদপ্তরাধীন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০৫টি। সার্টিফিকেট স্তর, ডিপ্লোমা স্তর ও ডিগ্রী স্তর, এ তিনটি স্তরে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সার্টিফিকেট পর্যায়ে রয়েছে ১৪৯টি সরকারী টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এবং একটি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। ডিপ্লোমা পর্যায়ে ৫০টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ডিগ্রী পর্যায়ে একটি টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণ, মূল্যায়ন ও উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব পালনে ১৯৬৭ সালের ১ নম্বর সংসদীয় কারিগরী শিক্ষা আইনবলে গঠিত হয় কারিগরী শিক্ষা বোর্ড। যার পরবর্তী নাম বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা বোর্ড। বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা বোর্ড চাহিদার আলোকে কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদী তিন-ছয় মাস থেকে চার বছরে মোট ৩৪টি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত কারিগরী শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১,১১৮টি। এ ছাড়া কারিগরী শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত রেজিস্টার ট্রেনিং অর্গানাইজেশন (আরটিও)-এর সংখ্যা ৬২৩টি। (তথ্যসূত্র: কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তর ওয়েবসাইট)
কারিগরী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের এখনো অভাব। ফলে ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বহুদেশের দক্ষ জনবল এ দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে একটা বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এ দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ তরুণ, যুবাদের কর্মসংস্থান ও আত্ম-কর্মসংস্থানে কারিগরী শিক্ষার বিকল্প নেই। কারিগরী শিক্ষায় দক্ষ হয়ে একদিকে যেমন তারা দেশের দক্ষ জনবলের অভাব পূরণ করতে পারে অন্যদিকে বিদেশে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে নিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করা, মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের সঠিক ব্যবহারে দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে কারিগরী শিক্ষার হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কারিগরী শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত কারিগরী শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার বাস্তবসম্মত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে কারিগরী শিক্ষাকে গ্রাম পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে নেয়া হয়েছে। কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সরকারের ক্রমবর্ধনশীল অর্থায়ন এবং উদ্যোগে বর্তমানে দেশে কারিগরী শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ হলেও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে বাজেটে অর্থায়ন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সরকারী বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভাগীয় শহর ছাড়াও জেলা পর্যায়ের সরকারী টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি) গুলোর কোথাও কোনো কারিকুলামের দুর্বলতা, প্রচারণার অভাব, শিক্ষক সংকট বা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি রয়েছে কিনা তার সঠিক তদারকি প্রয়োজন। এতে একদিকে যেমন সরকারী অর্থের অপচয় কমবে, সেই সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত ফলও অর্জিত হবে। ‘কারিগরী শিক্ষা নিলে বিশ্বজুড়ে কর্ম মিলে’ স্লোগান এর সঙ্গে মিল রেখে প্রয়োজন- জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক জনসচেতনতা। জনসাধারণের দোরগোড়ায় যদি কারিগরী শিক্ষার সুফল পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করাও সম্ভব হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও ফিচার লেখক
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ