ঢাকা, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১০ রজব ১৪৪৬

রপ্তানি থুবড়ে পড়ার শঙ্কা

প্রকাশনার সময়: ১৩ জুন ২০২৪, ০৮:১৫

বাংলাদেশ থেকে বিমানে আমদানী-রপ্তানীতে বেড়েছে পণ্য পরিবহনের ব্যয়। শুধু অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো পণ্য পরিবহনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে দিল্লি বিমানবন্দরের দিকে ঝুঁকছে। ফলে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আয় থেকে, যা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পাশাপাশি শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের রপ্তানী মুখ থুবড়ে পড়ার। আমদানী-রপ্তানী খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিমান দিয়ে পণ্য আমদানী-রপ্তানীতে বাড়তি ব্যয় ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দ্রুত পণ্য পেতে বিমানের বিকল্প নেই। কিন্তু বাড়তি ব্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো পণ্য পরিবহনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে দিল্লি বিমানবন্দরকে বেছে নিচ্ছে। কারণ দিল্লি বিমানবন্দরে পণ্য পরিবহন ব্যয় কম। এতে রপ্তানীমুখী ব্যবসায়ীদের মুনাফায় টান পড়েছে। তা সত্ত্বেও বিদেশী ক্রেতা ধরে রাখার স্বার্থে অনেক রপ্তানীকারক কম মুনাফা করছেন এবং কেউ কেউ লোকসানের মুখেও পড়ছেন।

সূত্র জানায়, রপ্তানী পণ্য বিদেশে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম উড়োজাহাজ। এ মাধ্যমে বেশী যাচ্ছে পচনশীল পণ্য। আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শুল্ক এত বেশী যে, ক্রেতারা তাদের পণ্য ট্রাকে করে বেনাপোল ও পেট্রাপোল হয়ে ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লি নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরী পোষাকের আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো পণ্য পরিবহনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে দিল্লি বিমানবন্দরকে বেছে নিচ্ছে। কারণ দিল্লি বিমানবন্দর কম শুল্ক আরোপ করে। শুধু দিল্লি নয়; বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের রপ্তানীকারকরাও বিদেশে কম খরচে পণ্য পৌঁছাতে পারেন। আর পরিবহন খরচ বেশী হওয়ায় প্রতিযোগীদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না বাংলাদেশের রপ্তানীকারকরা। ফলে চড়া দামের কারণে ক্রেতা হারাচ্ছেন তারা।

বাড়তি ভাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষিপণ্য রপ্তানীকারকরা। কারণ সবজীর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পণ্যগুলোর ধরন একই। তিন দেশের রপ্তানীর গন্তব্যও একই। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের ভাড়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশী হওয়ার কারণে বিদেশী ক্রেতারা তাদের থেকেই পণ্য কিনছেন বেশী। আর সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রপ্তানীকারকরা পিছিয়ে পড়ছেন। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে এক কেজী পোষাক পণ্য ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে পরিবহন করতে খরচ হয় ৩ ডলার। অথচ একই পরিমাণ পণ্য দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পাঠালে খরচ হয় ১ দশমিক ২ ডলার। মূলত শাহজালাল বিমানবন্দরের উচ্চ শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও সার্ভিস চার্জ গ্রাহকদের ঢাকা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কারণ এখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ৭২ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়। আবার সময়মতো ফি পরিশোধ না করলে ৬০ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হয়।

অতিরিক্ত চার্জের কারণে স্থানীয় এয়ারলাইন্স, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, কুরিয়ার কোম্পানী, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারসহ সংশ্লিষ্ট অনেক খাত ব্যবসা হারাচ্ছে। এ ছাড়া শাহজালালের ছোট কার্গো ভিলেজ থেকে পণ্য চুরি, অযত্নে ফেলে রাখা এবং পণ্যের মানের অবনতি হওয়া নিয়ে গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ আছে।

সূত্র আরো জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে শিগগিরই চালু হবে স্বপ্নের তৃতীয় টার্মিনালের কার্যক্রম। এতে বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা এবং যাত্রী পরিষেবার নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে নতুন করে বিভিন্ন দেশ এখান থেকে তাদের এয়ারলাইন্স সেবা চালু করবে। এমনকি বাংলাদেশকে একটি অ্যাভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম মাইলফলক হিসেবে ধরা হচ্ছে। কিন্তু বিমানবন্দর ব্যবহারে উচ্চ শুল্ক ও নানাবিধ ব্যয় এ স্বপ্ন ফিঁকে হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দরের বিমান ওঠা-নামার ক্ষেত্রে একটি রানওয়ে হওয়ায় সময়ক্ষেপণ বা জটও ভাবাচ্ছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এ সমস্যা আরো বাড়বে। এতে আগামীতে কি সুফল মিলবে এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

এখন ব্যয় কমাতে দিল্লি বিমানবন্দরের দ্বারস্থ হচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। আর থার্ড টার্মিনাল নিয়ে আগামীতে স্বপ্ন দেখা হলেও বর্তমানেই শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান করতে পারছে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। গত কয়েক দিন থেকে বিমানবন্দরের মালয়েশিয়াগামী ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে শত শত শ্রমিক টিকিট না পেয়ে বিমানবন্দর এবং এর আশপাশে গত প্রায় ১৫ দিন থেকে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ডলার সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশী এয়ারলাইনসগুলোর বকেয়া প্রদান করতে না পারায় কম দামের টিকিট বাংলাদেশে বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে এয়ারলাইনসগুলো। ফলে বাড়তি দামে টিকিট বিক্রি করছে বিদেশী এয়ারলাইনসগুলো।

এদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার টন কার্গো জাহাজী হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার টন পোশাক পণ্য এবং ৩০ হাজার টন শাকসবজী, ফল ও অন্যান্য সামগ্রী। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বিমানবন্দর দিয়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার টন কার্গো বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার টন পোশাক পণ্য এবং ২৪ হাজার টন ফল, শাকসবজীসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ। বর্তমানে ৪০০ টন রপ্তানীযোগ্য পণ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা থাকলেও সাধারণ সময়ে দৈনিক শিপমেন্ট গড়ে ৮০০ টন এবং ব্যস্ত সময়ে ১ হাজার ২০০ টনে পৌঁছে যায়। তাছাড়া শাহজালালের ছোট কার্গো ভিলেজ থেকে পণ্য চুরি, অযত্নে ফেলে রাখা এবং পণ্যের মানের অবনতি হওয়া নিয়ে গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ আছে। কয়েক বছর আগেও কাতার ও ইতিহাদ শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ডেডিকেটেড ফ্লাইটে কার্গো পরিবহন করত। বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে পরিবহন করা পণ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের মাধ্যমে বহন করা হয়, বাকিগুলো কার্গো ফ্লাইটে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ জানান, ঢাকা বিমানবন্দরে ফ্রেইট চার্জ অত্যন্ত বেশী। দিল্লি বিমানবন্দর ব্যবহার করতে ঢাকা থেকে ভারতের রাজধানীতে পণ্য পরিবহনের পরও রপ্তানীকারকরা প্রতি কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ মার্কিন সেন্ট সাশ্রয় করতে পারেন। এদিকে গত বছর এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহনের প্রধান সমুদ্রপথ লোহিত সাগরের সুয়েজ খালের ঐতিহ্যবাহী রুট ব্যবহারকারী কার্গোবাহী জাহাজগুলো হুতিদের হামলার শিকার হয়েছে। এরপর থেকে উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহন বেড়েছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ