বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ খুব বেশী দায়ী নয়। অথচ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ দেশটি। উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উন্নয়নের বলি হচ্ছে বাংলাদেশ তথা এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তারা ব্যাপকহারে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে পাল্লা দিয়ে।
তাতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে গেছে যেমন, তেমনি আবার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সিএফসি গ্যাসের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। এক কথায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালীপনার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। যে গ্যাস নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর ফিল্টার নামে খ্যাত ওজোনস্তর ক্রমশ পাতলা হয়ে ভূপৃষ্ঠ তপ্ত হচ্ছে। যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে বছর-বছর।
গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে যেমন, তেমনি শীতে তাপমাত্রা মাইনাসের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। শীতপ্রধান দেশগুলোর কথা ভিন্ন। তবে শীতপ্রধান দেশ মাইনাসের কারণে নয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাবে হিমবাহের চাঁই গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন, তেমনি সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে জলস্ফীতি হয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।
এ ছাড়াও ওয়ার্ল্ড রিস্ক রিপোর্ট-২০১৮ অনুযায়ী বিশ্বের আরো ১৫টি দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ২০১৬ সালে এন্টার্কটিকার ৯৬৫ বর্গ কিলোমিটারের হিমবাহের চাঁইয়ে চিড় ধরতে দেখেছেন গবেষকরা। ২০২০ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ৫৩২ বিলিয়ন টন বরফ গলেছে গ্রিনল্যান্ড থেকে। ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ডে তিন কিলোমিটারের বরফের চাঁই ভেঙে পড়েছে। তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ জল বৃদ্ধি পেয়েছিল। বরফের চাঁই গলতে শুরু করায় সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে মোড় নিয়েছে। সমুদ্রে প্রতি সেকেন্ডে ছয়টি অলিম্পিক সুইমিং পুলের সমপরিমাণ জল পড়ছে। তাতে দেখা গেছে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টন জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফের চাঁই গলার পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটেনের ‘ইউনিভার্সিটি অব লিনকন’ এক গবেষণায় জানিয়েছে, ‘গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলার কারণেই ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ১০-১২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে।’
অপরদিকে ‘নেচার ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, আর্কটিক মহাসাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বরফ যুগেও দেখা গিয়েছিল। উল্লেখ্য, সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিগত ৪০-১০০ বছরের মধ্যে দেখা গেছে গ্রিনল্যান্ডের তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই উত্তর মেরুর পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল, সেখানকার তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গিয়ে ঠেকেছিল। অপরদিকে ২০২৩ সাল বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। বর্তমানে যে হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে। আর সেটি হলেই পৃথিবী মহাদুর্যোগের মুখোমুখি পড়বে।
জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এভাবে বরফগলা অব্যাহত থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে দ্রুত। ফলে বিশ্বের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হবে ব্যাপকভাবে। সেই তালিকার মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের নামও।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং শৈত্যপ্রবাহের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধরনের দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। সেটি হতে পারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প ও নদী ভাঙনসহ নানা দুর্যোগ। তার মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে পৃথিবীকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার কারণে। যার প্রমাণ আমরা বার কয়েক পেয়েছিও। সিডর, আইলা, বুলবুল, আমফান ও ইয়াসের তাণ্ডবলীলায় মারাত্মক দুর্যোগের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। তবে পশ্চিমবঙ্গে ইয়াস ভয়ঙ্করভাবে আঘাত হানলেও সামান্য দিক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সেই যাত্রায় কিছুটা রক্ষা পেয়েছিল। তথাপিও উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির খবর আমরা জানতে পেরেছি। এসব প্রাকৃতিক তাণ্ডব ঘটছে শুধু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলেই, যার মূল কারণই হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য বিজ্ঞানীরা মানুষকেই দায়ী করেছেন। যার জন্যই মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অব্যাহত রয়েছে আর পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুর। যা আমাদের কাছে জলবায়ু সংকট হিসেবে পরিচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ধারণা থাকা সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শুধু কাগজ-কলমের মধ্যেই তাদের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে। উন্নত দেশের কর্মকাণ্ডে সমগ্র পৃথিবী আজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সূত্রমতে জানা যায়, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব প্রান্তিসীমা ৩৫০ পিপিএম ছাড়িয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক ৩৯৮.৫৮ পিপিএম ঘনমাত্রায় পৌঁছে গেছে, যা পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রতি মারাত্মক হুমকিই বলা যায়। জাতিসংঘ কর্তৃক জলবায়ুবিষয়ক এবং বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনেরোতে কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে গঠিত হয় ‘জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশন’ (ইউএনএফসিসিসি)।
ওই কনভেনশনে, ১৫০ দেশকে এ নতুন বিধান মেনে চলতে রাজি করানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রশমনে বাধ্যতামূলক করতে প্রটোকল ঘোষণা করা হয়। মূলত ওই সময় থেকেই সদস্য দেশগুলো প্রতি বছর মিলিত হওয়ার জন্য সম্মত হয় এবং প্রতি বছর মিলিত হচ্ছেও। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হচ্ছে না। গাছের গোড়া কেটে জল ঢালার মতো দরিদ্র দেশকে কিছু অনুদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে শুধু। অথচ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের কারণে মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতোমধ্যেই লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকায় মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার কারণে বাধ্য হয়ে বাস্তুহারা হতে হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠীকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশী বাস্তুহারা হয়েছেন, আর তাদের অধিকাংশই এখন শহরমুখী হচ্ছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত আর মাত্র ৪৫ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেই উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ শতাংশ ভূমি জলে তলিয়ে যাবে।
তবে এ অভিমত অপ্রতিষ্ঠিত হিসেবে ধরে নিচ্ছেন অন্য গবেষকদল। কারণ ইতোমধ্যে জানা গেছে, ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন জায়গাগুলোতে ভারসাম্য বজায় থাকবে সমুদ্রে উচ্চমাত্রার পলির আগমনে। ইতোমধ্যে তার কিছুটা প্রমাণও মিলেছে। যেমন হাতিয়া অঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশাল আয়তনের চর জেগেছেও। অন্যদিকে ২০০৫ সালে ‘আইপিসিসি’ জানিয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২১ শতাংশ লবণাক্ত জলে সয়লাব হয়ে যাবে। নানা ধরনের তর্ক-বিতর্কের ফলে সর্বশেষ যা আমরা অবগত হয়েছি তা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ মহাদুর্যোগের মুখোমুখি হবে, যা অবধারিত সত্য কথা। আর এ মহাদুর্যোগের জন্য দায়ী হচ্ছে শুধু শিল্পোন্নত দেশের খামখেয়ালিপনা। শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস অধিকহারে নিঃসরণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে হিমবাহের চাঁই গলতে ত্বরান্বিত করছে। ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরো কিছু দেশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই বিপর্যয় থেকে আদৌ উত্তরণ মিলবে কিনা তাতে সন্দিহান আমরা। যদি বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয় তবে আমরা এ মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণ পাব হয়তোবা। তাই বিশ্ববিবেকের কাছে আমাদের আর্জি, সময় থাকতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন; কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে জলবায়ু যুদ্ধে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বিজয়ী করতে সাহায্য করুন।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ