ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল

প্রকাশনার সময়: ১২ জুন ২০২৪, ০৮:১২

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়। তাকে আটকের বিষয়টি ডিবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও একাধিক ডিবির সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, আনারের মৃত্যুর বেনিফিশিয়ারি হিসেবে দেখা হচ্ছে সাইদুল করিম মিন্টুকে। তা ছাড়া আনারের মেয়ে মামলার বাদী মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনও মিন্টুকে সন্দেহভাজন হিসেবে ডিবিকে তথ্য দিয়েছেন। তাই আওয়ামী লীগের এ নেতাকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে। আনারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সাইদুল করিম মিন্টুকে শুরু থেকেই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন হিসেবে দেখছেন আনারের পরিবার।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তারের পর থেকে মিন্টুর বিষয়টি সামনে চলে আসে। কারণ গ্যাব বাবু মিন্টুর সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া আনার হত্যার পর গ্যাস বাবুর গাড়িতেই আনারের বাসায় সান্ত্বনা দিতে যান জেলা সেক্রেটারি মিন্টু। সূত্র মতে, গ্যাস বাবুর সঙ্গে হোয়াটঅ্যাপে মিন্টুর কনভারসেশন পাওয়া গেছে। সেখানে সেনসেটিভ কিছু তথ্য রয়েছে।

সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। এমনকি গ্যাস বাবু ও মিন্টুকে মুখোমুখিও করা হতে পারে। যদিও গ্যাস বাবু মিন্টুর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হোয়াটঅ্যাপের পাওয়া তথ্যের বিষয়ে সে মুখ খুলতে নারাজ। এ কারণে মিন্টুকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিন্টুর সঙ্গে আনারের বিরোধ ছিল। এরই মধ্যে গত নির্বাচনের আগে আনারের নির্বাচনী এলাকায় প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ শুরু করে জেলা সেক্রেটারি মিন্টু। যদিও মিন্টুর অন্য উপজেলার বাসিন্দা। তারপরও তিনি ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ করেন। তার সঙ্গে ছিল আনারের নির্বাচনী এলাকার অনেক নেতাই।

পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশে উত্তপ্ত ছিল কালিগঞ্জের মাটি। আতঙ্কে ছিলেন খোদ দলের নেতাকর্মীরাও। পরে আনার মনোনয়ন পাওয়ার পর চুপ হয়ে যান মিন্টু ও তার অনুসারীরা। মাঠের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আনারের লোকজনের হাতে।

এসব বিষয়ও তদন্তে আনা হচ্ছে। সূত্রমতে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন আনারের মেয়ে ডরিন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, মিন্টুর সঙ্গে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) মো. শাহিদুর রহমানের বিশেষ সখ্য রয়েছে। এ অভিযোগ পাওয়ার পর শাহিদুরকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা থেকে বরিশালে বদলী করা হয়েছে। এ বিষয়েও মিন্টুর কাছে জানতে চাওয়া হবে। কারণ ঘটনার পর মো. শাহিদুর রহমান মামলার বিষয়ে বেশী আগ্রহ দেখান। এমনকি প্রধান খুনী শিমুল, তানভীর ও শেলাস্তিকে গ্রেপ্তারও করান। কিন্তু মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে শাহীনের নাম বলা হলেও এর পেছনে আর কারা জড়িত সেটি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে ডরিন বারবার অভিযোগ করে আসছেন। কারণ শাহীনের মতো একজন চুনোপুঁটির পক্ষে আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা সম্ভব না।

আনার হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, সংসদ সদস্য আনার চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা আমরা কখনোই বলিনি। আমরা সব সময় বলে আসছি, এমপির ওই এলাকা সন্ত্রাসপূর্ণ একটি এলাকা। মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে হাইওয়ে পুলিশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওখানে সত্যিকারে কী হয়েছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। আমরা তদন্ত করছি, তদন্তের পরে আপনাদের সব কিছু জানাব।’ সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে ডরিন সন্দেহভাজনদের নাম বলেছেন, তার মুখে কার কার নাম এসেছে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যখন তদন্ত চলে তখন আমাদের মন্ত্রী, আইজিপি কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে তদন্ত না করে কোনো কিছু বলা সম্ভব না। আমরা মনে করি তদন্ত শেষ হলে এগুলো নিয়ে কথা বলব।’

নজরদারীতে ঝিনাইদহের আরো কয়েক নেতা: আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঝিনাইদহের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে নজরদারীতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার পর আসামিরা কার কার কাছে শেয়ার করেছেন তা তদন্ত চলছে। ছবি দিয়ে কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে কিনা, কাদের মাধ্যমে লাভবান হয়েছে, সব বিষয় তদন্ত করে বের করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার রাজধানীর মিন্টো রোডে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকে নজরদারিতে রাখছেন, একজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও এনেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন। বাংলাদেশে ও ভারত মিলে দুটি মামলা হয়েছে। দুই দেশেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন। আমরা কাজ করছি। আসামির সঙ্গে আমরা কথা বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সব তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে মনে করেছি, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এ জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনেছি। তার রিমান্ড চলছে, তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। ঘটনা ডিবি-ওয়ারি বিভাগ তদন্ত করছে।’

হত্যাকাণ্ডের পর দুই কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে কিনা প্রশ্নে হারুন বলেন, ‘এগুলো আমরাও শুনেছি, সব কিছু তদন্ত করছি। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন বাংলাদেশ থেকে দিল্লির পর কাঠমান্ডু এরপর দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। তাকে আমরা ধরতে না পারলেও মোটামুটি বাকি সব আসামির বিষয়ে জানতে পেরেছি। আসামিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করেছি। ভারতে জিহাদ গ্রেপ্তার হয়েছে। এছাড়া কাঠমান্ডু থেকে গ্রেপ্তার সিয়ামকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রয়োজন মনে করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাব।’

উল্লেখ্য, গত ১২ মে ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে নিখোঁজ হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। পরে তাকে হত্যার খবর আসে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের স্বীকারোক্তি অনুসারে কিছু হাড় ও মাংস খণ্ড উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো আনারের কিনা তার ফরেনসিক পরীক্ষা চলছে।

কালীগঞ্জে মানববন্ধন: আনার খুন হয়েছেন না গুম হয়েছেন জানতে চেয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মানববন্ধন করেছেন স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গতকাল উপজেলার সলিমুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এই মাবনবন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে উপজেলা আওয়ামী লীগ যুবলীগের নেতার্কমীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেন।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ