টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি। এর মধ্য দিয়ে জওহরলাল নেহেরুর পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ইতিহাসে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হলেন। গতকাল রোববার নয়া দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে নরেন্দ্র মোদিকে শপথ বাক্য পাঠ করান দেশটির প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মু। এরপর শপথ বাক্য পাঠ করেন রাজনাথ সিংহ।
এভাবে একে একে অন্য মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করান প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মু। এবার ৭২ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছেন মোদি। এদের মধ্য ৩০ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পাঁচজন স্বতন্ত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ৩৬ জন প্রতিমন্ত্রী। কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন তা পরে ঘোষণা করা হবে। এদিকে নতুন মন্ত্রিসভায় থাকার জন্য ফোন পাননি বিজেপির এমন ২০ জন রয়েছেন, তারা হয়তো মন্ত্রিত্ব পাবেন না।
শপথ গ্রহণ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ভবন রাইসিনা হিলসে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া নেয়া হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অনুষ্ঠানে আট হাজারের বেশী অতিথির জন্য ব্যবস্থা করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহাল ওরফে প্রচণ্ড, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্দ জুগনাথসহ ৭ বিদেশী নেতা। রাষ্ট্রপতি ভবনে উপস্থিত আট হাজার অতিথির মধ্যে ছিলেন শাখরুখ খান, অক্ষয় কুমার, চলচ্চিত্র পরিচালক রাজকুমার হিরানি প্রমুখ।
মোদির শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাজ সাজ রব ছিল দিল্লিতে। কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয় রাজধানী। তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের ব্যবস্থা নেয় দিল্লি পুলিশ। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কারণে দিল্লির আকাশ সীমাতেও রোববার কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
রোববার শপথ নেয়ার মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেন মোদি। তার আগে কেবল জওহরলাল নেহেরু টানা তিনবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ মেয়াদকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি।
তবে মোদির নতুন মেয়াদ অনেক বেশী চ্যালেঞ্জিং হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে বিতর্কিত নানা রাজনৈতিক ও নীতিমালার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিভিন্ন দলের স্বার্থ এং শক্তিশালী বিরোধী দলের মুখে মোদিকে এ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট, প্রায় এক দশক ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এলেও এবার বিরোধী ইন্ডিয়া জোট নির্বাচনে বিস্ময়করভাবে একটি শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে পার্লামেন্টে সরকারের যে কোনো একপাক্ষিক বা একমুখী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সুযোগ পাবে কংগ্রেস পার্টি ও এর মিত্ররা। উল্লেখ্য, ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ পেয়েছে ২৯৩ আসন এবং ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩২ আসন। এছাড়া অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে পেয়েছে ১৮টি আসন। ছয় ধাপে ভোটগ্রহণ শেষে গত ৪ জুন ঘোষণা করা হয় ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে জয়ীদের নাম। নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন। আর কংগ্রেস জয়ী হয়েছে ৯৯টি আসনে। অন্য দলগুলোর মধ্যে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৩৭টি, তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি, ডিএমকে ২২টি, তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ১৬টি, জনতা দল (জেডি-ইউ) ১২টি, শিবসেনা (উদ্ভব) নয়টি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপিএসপি) সাতটি ও শিবসেনা (এসএইচএস) সাতটি আসনে জয় পায়। এছাড়া লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস) পেয়েছে ৫টি আসন। ৪টি করে আসনে জয় পেয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট)- সিপিআই (এম), ওয়াইএসআরসিপি ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)। ৩টি করে আসনে জয় পেয়েছে আম আদমি পার্টি, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) ও ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল)।
১৮তম লোকসভার মন্ত্রণালয়ে কারা থাকছেন, এনিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকার জন্য যারা ফোন পেয়ছেন প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে তারা মন্ত্রিত্ব পাবেন। সেজন্য প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছেন তারা। তবে ফোন পাননি এমন সিনিয়র সাংসদও রয়েছেন। বিজেপির এমন ২০ জন রয়েছেন, যারা হয়তো মন্ত্রিত্ব পাবেন না। তবে সেই ২০ জনকে ২০১৯ সালে মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন তারা।
সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম আজতাক বাংলা জানায়, এবার তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। যারা ফোন পাননি তারা এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেননি। এদের মধ্যে আবার এমন অনেকে রয়েছেন যারা ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে হেরে গেছেন। গতকাল রোববার সকালেই প্রধানমন্ত্রী নিজের বাসভবনে চা-চক্র ডাকেন। সেখানে তারাই উপস্থিত ছিলেন যাদের ফোন করে ডাকা হয়েছিল। মোট ২২ জন সাংসদ উপস্থিত ছিলেন বাসভবনে চা-চক্রে। তারা হলেন, সর্বানন্দ সোনোয়াল, চিরাগ পাসোয়ান, অন্নপূর্ণা দেবী, মনোহর লাল খট্টর, শিবরাজ সিং চৌহান, ভগীরথ চৌধুরী, কিরেন রিজিজু, জিতিন প্রসাদ, এইচডি কুমারস্বামী, এস জয়শঙ্কর, সিআর পাতিল, কৃষ্ণপাল গুর্জার।
এই তালিকায় নেই যে ২০ হেভিওয়েট— অজয় ভাট, সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি, মীনাক্ষী লেখি, রাজকুমার রঞ্জন সিং, জেনারেল ভি কে সিং, আর কে সিং, অর্জুন মুন্ডা, স্মৃতি ইরানি, অনুরাগ ঠাকুর, রাজীব চন্দ্রশেখর, নিশীথ প্রামাণিক, সুভাষ সরকার, জন বার্লা, ভারতী পানওয়ার, অশ্বিনী চৌবে, রাওসাহেব দানভে, কপিল পাতিল, নারায়ণ রানে ও ভগবত করাড।
এদিকে, বিজেপি সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতের স্থানীয় গণমাধ্যম আজতাক বাংলা জানায়, বাংলা থেকে সুকান্ত মজুমদার ও অনুরাগ ঠাকুরকে মন্ত্রি করা হতে পারে। তবে তারা পূর্ণ মন্ত্রির দায়িত্ব পাবেন কিনা তা এখনো স্পষ্ট নেই। এর আগের ৫ বছরের মেয়াদে শান্তনুকে জাহাজ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এবারও তার মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে সুকান্ত মজুমদারকে নিয়ে কোনো খবর এখনো সামনে আসেনি।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ