ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নেটের গতিতে ফাঁকি

প্রকাশনার সময়: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:৫৫ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:৫৭
ফাইল ছবি

ট্রাভেল এজেন্সিতে টিকিটিং অফিসার হিসেবে চাকরি করেন সাজ্জাদ হোসেন। থাকেন পুরান ঢাকায়। এয়ার টিকিট বিক্রির নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। ফলে অফিসের বাইরেও সারাক্ষণ ইন্টারনেট সংযোগে থাকতে হয়। মোবাইল ইন্টারনেটে ব্যয় বেশি হয় দেখে বাসায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েছেন। মাসে ৫ এমবিপিএস ৫০০ টাকায়। তবে প্রায়ই দেখা যায়, বাসার ইন্টারনেটে ফেসবুক-ইউটিউব চললেও এয়ার টিকিট বুকিং সফটওয়্যার কাজ করে না। তখন মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। বাধ্য হয়ে বাড়তি ৩০০ টাকা দিয়ে সংযোগ ১০ এমবিপিএস করে নিয়েছেন। এতে আগের চেয়ে ইন্টারনেটের গতি কিছুটা বাড়লেও মনমতো হচ্ছে না।

রাজধানীর বারিধারা এলাকার কল্যাণ দাস। তিনি একজন ফ্রি-ল্যান্সার। বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ নেন ৮ এমবিপিএস ৮০০ টাকায়। রাতে ইন্টারনেটের ভালো স্পিড থাকে। তবে দিনে নেট এতটাই স্লো থাকে মনে হয় দুই বা তিন এমবিপিএস পাচ্ছে। বাধ্য হয়েই ইন্টারনেটে প্রোভাইডার পাল্টে আবার নতুন সংযোগ নিয়েছেন। গতি আগের চেয়ে একটু ভালো পেলেও কাজ হচ্ছে না।

সাজ্জাদ ও কল্যাণ দাসের মতো অনেক গ্রাহকেরই অভিযোগ সর্বনিম্ন রেটের এ ইন্টারনেট ঠিকমতো কাজ করে না। ইন্টারনেটের সঠিক গতি পাচ্ছেন না তারা। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কাজ করতে প্রচুর সময় লাগছে।

জানা গেছে, পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে দেশে ‘এক রেটে’ ইন্টারনেট সেবামূল্য (ট্যারিফ) চালু করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি)। ফলে সারাদেশে এক দাম ও সর্বনিম্ন রেটে ইন্টারনেট পাচ্ছেন গ্রাহকরা। নতুন দাম হিসাবে খুচরায় ৫ এমবিপিএস ৫০০ টাকা, ১০ এমবিপিএস ৮০০ এবং ২০ এমবিপিএস ১ হাজার ২০০ টাকায় পাবেন গ্রাহকরা। এখন থেকে এই তিন প্যাকেজের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের নির্ধারিত মূল্যের বেশি দাম নেয়া যাবে না, তবে কম নেয়া যাবে। এতে গ্রাম বা শহর সব জায়গাতেই সর্বনিম্ন ৫০০ টাকায় ইন্টারনেট পাবেন গ্রাহকরা। এক রেটে ইন্টারনেট কার্যকর হলেও এই ইন্টারনেটের সত্যিকার গতি কত তা নিয়ে রয়েছে অনেকের প্রশ্ন।

এর আগে গত ৬ জুন ‘এক দেশ এক রেট’ ইন্টারনেট ঘোষণা দেয়ার পরে তা বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছিল। ইন্টারনেটের একেক পর্যায়ে একক দর ছিল। তাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের তিনটি ধাপে খুচরা পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), বেসরকারি নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) অভিন্ন ট্যারিফ চালু করা হয়েছে। এতে আইআইজি ও এনটিটিএন চালু হওয়ার ১২ বছর পর এ সেবামূল্য নির্ধারণ করা হলো।

আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের ঘোষণার পর বেশিরভাগ ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের প্যাকেজে পরিবর্তন এনেছে। একই প্যাকেজের মূল্য আগে বেশি থাকলেও তা কমিয়েছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর থেকেই ৫০০ টাকায় ৫ এমবিপিএস ব্যান্ডইউথ সেবা দিয়ে আসছে, তবে তা শহরে যেখানে গ্রাহক বেশি সেখানেই সম্ভব ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে গ্রাহকদের ব্যান্ডইউথ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে ইন্টারন্টে প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সর্বনিম্ন দরে ইন্টারনেট গ্রাহকরা আরো আগে থেকেই পেয়ে আসছে। কিন্তু এখানে একটি ফাঁক রয়েছে। বিশেষ করে সর্বনিম্ন দরে যে লাইন দেয়া হয়, সেগুলো শেয়ারড লাইন। এখানে গ্রাহক চাইলে তার মনমতো স্পিড পাবেন না। কারণ ৫০০ টাকায় যারা প্যাকেজ নিচ্ছে, তাদের এ সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে একজনের ইন্টারনেট সংযোগের গতি আট ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তাই বেশিরভাগ গ্রাহক এতে সন্তুষ্ট নন। তাদের ব্যান্ডউইথ ও স্পিডের চাহিদা অনেক বেশি। বিশেষ করে করপোরেট অফিস শেয়ারড ইন্টারনেট দিয়ে চলে না। তাদের ডেডিকেটেড ব্যান্ডউইথ নিতেই হয়। তবে এক্ষেত্রে মাসিক চার্জও তুলনামূলক বেশি।

আইএসপি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আরো বলেন, সর্বনিম্ন রেটে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া সম্ভব। তবে তা খুব যে কার্যকর হবে তা নয়। কারণ ৫০০ টাকায় শেয়ারড লাইন ছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়। সর্বনিম্ন প্যাকেজ যদিও ভ্যাটসহ ৫২৫ টাকা খরচ পড়ে, অপারেটররা ৫০০ টাকাই রাখছেন। তবে, গ্রাহকের সুবিধার জন্য কেউবা ১ বনাম ৮ এর জায়গায় ১ বনাম ৩ বা ১ বনাম ৪ করছেন। আবার অনেকে ১ বনাম ৮ শেয়ারিং লাইন দিলেও ৫ এমবিপিএসের জায়গায় ৮ এমনকি ১০ এমবিপিএস স্পিডও দিচ্ছে। টাকাও একটু বাড়তি নিচ্ছে। কারণ, সব গ্রাহকের এক সঙ্গে একই সময় ইন্টারনেটের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে কোনো গ্রাহক ব্যবহার না করলে অন্যরা তখন তুলনামূলক ভালো স্পিড পায়। কেউ বিশেষ কোনো কাজ করতে চাইলে কিংবা বাফারিং (ধীরগতি) মুক্ত নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট চাইলে তাকে ডেডিকেটেড লাইন নিতেই হবে। তবে এক্ষেত্রে বেশি খরচ করতেই হবে।

জানতে চাইলে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থার অন্যান্য স্তরে দাম ঠিক না থাকলে গ্রাহক পর্যায়ে এক দেশ, এক রেট টেকসই করা বেশ কঠিন। তাই সেবার মান নিশ্চিত করতে বিটিআরসির নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক বলেন, সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। তবে এখানে কথা আছে এ ইন্টারনেট কিন্তু ওয়ান বাই এইট শেয়ারিং ব্যান্ডউইথ। তার মানে ৫০০ টাকায় ৫ এমবিপিএস কিন্তু ইন্টারনেট পাবে না, পাবে ৬২৫ কেবিপিএস। এই গতির ইন্টারনেট নিয়ে তারা তেমন কিছুই করতে পাবে না। ইউজাররা হ্যাপি থাকবে না। এখানেই একটু বোঝার ভুল রয়েছে।

তিনি বলেন, অনেকে মনে করে ৫০০ টাকায় ৫ এমবিপিএস গতি পাবে। এ ডাটা ৮ জনে শেয়ার করলে তা যে ৬২৫ কেবিপিএস হয়, এ কথা অনেকেই বলে না। মনে করেন কেউ শেয়ারড লাইন নিল। তার বাসায় লোক ৪ জন, তাহলে ৬২৫ কেবিপিএস গতিও চার ভাগ হয়ে যাবে, এ গতি দিয়ে সে কী করতে পারবে? তাই কাজ করতে চাইলে তাকে প্যাকেজে আপডেট করে নিতেই হবে। তখন কিন্তু সর্বনিম্ন দাম থাকবে না।

সর্বনিম্ন রেটে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে এমদাদুল হক আরো বলেন, ৫ এমবিপিএস ডেডিকেটেড (এক লাইন এক ইউজার) লাইনে অপারেটরের ২০০০ টাকার মতো খরচ পড়ে। তাহলে সে ৫০০ টাকায় ৫ এমবিপিএস দেবে কীভাবে? কোনো প্রতিষ্ঠান হয়তোবা ১০০ টাকা বেশি নিয়ে ৮ জনের ক্ষেত্রে ৪ বা ৫ জনকে একটি শেয়ার লাইন দিচ্ছে। গ্রাহকও একটু ভালো গতির ইন্টারনেট পাচ্ছে। এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবাদাতা রিসেলার হিসেবে যে নিম্নমানের সেবা দিচ্ছে, সেখানেও হস্তক্ষেপ করা হবে। দাম ও গতির এ বিষয়গুলো সমাধান করা হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ