স্টোফ গ্যান্স পরিচালিত ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ মুভিটি সর্বপ্রথম ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪-তে ফ্রান্সে মুক্তি পায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং হয়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায় মুভিটি। ফরাসি-জার্মান যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত রোমান্স-ফ্যান্টাসি ঘরানার মুভিটি ক্ল্যাসিক হিসেবে সমাদৃত। চলচ্চিত্রটির মূল থিম ভালোবাসা, পশুত্ব ও মনুষ্যত্ববোধ।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত মার্কিন লেখক রিচার্ড লেমনের হরর উপন্যাস ‘দ্য বিস্ট হাউস’ প্রকাশিত হয়। এটিও মানবীয় সত্তার সঙ্গে পাশবিকতার সংগ্রাম আখ্যানের মূল উপজীব্য। ব্রিটিশ ভারতের বিশিষ্ট উর্দু লেখক ও কবি আলিম উল হক হাক্কির লেখা উপন্যাস দ্য বিস্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা এবং সামাজিক অবিচারকে থিম করে গড়ে উঠেছিল দ্য বিস্ট উপন্যাসের গল্প। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বিখ্যাত মার্কিন লেখক হেনরি জেমসের ছোটগল্প ‘দ্য বিস্ট ইন দ্য জঙ্গল’এর কাহিনীও মানবিক টানাপোড়েন ও পাশবিকতা।
সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে Beast এর ব্যবহার কেমন সে সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া গেল। Baest মানে জন্তু।
এবার ২০২৪ সালে ঠিক হজ মৌসুমের আগ দিয়ে সৌদি আরবের রিয়াদে চালু করা হলো ‘বিস্ট হাউস’ নামের নাইট ক্লাব। এত দিন আমরা নাইট ক্লাবকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বলেই জানতাম। সৌদি আরব তাদের ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে পাশ কাটিয়ে দেশটার খোলনলচে এমনভাবে পাল্টে দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছে, তাতে কথিত উদারনৈতিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে খুব বেশী পার্থক্য আর থাকছে না।
পশু প্রকৃতির ব্যক্তিকে ইংরেজিতে Beast বলে। পশু খারাপ এটা বলার সুযোগ নেই। তবে মানুষের মধ্যে বন্যতা চলে এলে সেটার ভালোমন্দ নিয়ে সমালোচনা হবেই। জঙ্গলে পশুদের সমাজে পশুদের যাপিত জীবন নিয়ে কারো নিন্দা নেই, তবে মানুষের সমাজে যদি পাশবিকতা আরোপ করা হয় সেটা নিয়ে কথা হবেই।
আমরা একটু পেছনে ফিরলে দেখব, ২০১৯ সালে সৌদি সরকার রাষ্ট্রীয় ফরমান জারী করে ঘোষণা দেয় তাদের জেদ্দা শহরে চালু হবে ‘নাইট ক্লাব’। তবে সেটা হবে ‘হালাল নাইট ক্লাব।’ সেখানকার সব খাবার হালাল হবে।
দুবাই ও বৈরুতের বিখ্যাত ব্র্যান্ড নাইট ক্লাব হোয়াইটের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে সৌদি আরবের জেদ্দা। ওতে থাকবে বিলাসবহুল ক্যাফে এবং লাউঞ্জ। হালাল নাইট ক্লাবে ওয়াটারফ্রন্ট থাকবে, এর সঙ্গে থাকবে বিশ্বের খ্যাতনামা মিউজিক গ্রুপের পরিবেশনা। ইলেকট্রনিক ডান্স মিউজিক, বাণিজ্যিক মিউজিক, হিপহপ মিউজিক উপভোগ করা যাবে হালাল নাইট ক্লাবে।
ওই নাইট ক্লাবের লাউঞ্জের একটি অংশে থাকবে নাচের ফ্লোর। নারী-পুরুষ সবার জন্য এ ফ্লোর উন্মুক্ত থাকবে। হোয়াইটের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই ওখানে পাওয়া যাবে। তবে ওই নাইট ক্লাবে মদ জাতীয় পানীয় পাওয়া যাবে না। সৌদিতে মদ কেনাবেচা অবৈধ। আর কেউ যদি মদ কেনাবেচা করে, তাকে শাস্তি পেতে হয়।
ওই সময় সেদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। নাইট ক্লাব কালচার হালাল হয় কেমনে, এটা নেটিজেনদের বুঝে আসছিল না। কিন্তু এবার রিয়াদে চালু হওয়া যে নাইট ক্লাবের খবর মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম সিয়াসাত ডেইলি’র বরাতে পরিবেশন করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে ওই বিস্ট হাউসে অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পরিবেশন করা হবে এবং নারীরাও প্রবেশাধিকার পাবে। যা সৌদির ঐতিহ্যগত অ্যালকোহল নিষেধাজ্ঞা এবং নারী-পুরুষের অবাধ সহাবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
এ ছাড়া বহুমূল্যের বিনিময়ে বিলাসবহুল সুযোগ সুবিধাও দেয়া হবে। যারা এটি তৈরী করেছেন তারা আশা করছেন, এটি ক্রমেই শিল্প ও সংগীতের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। ক্লাবটিতে অনেক স্টুডিও রাখা আছে। একটি ডাইনিং এরিয়াও তৈরী করা হয়েছে। অনেক ডিজে এবং সংগীত প্রযোজকও এখানে উপস্থিত থাকবেন। যা গোটা নাইট ক্লাবটিকে বিদেশীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে বলে জানানো হচ্ছে।
ক্লাবটি প্রসঙ্গে সৌদি আরবের ডিজে তারেক আন্তাবি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এত দিন দেশের বাইরে অর্থাৎ বিদেশে পারফর্ম করতাম। এবার দেশের নাইট ক্লাব আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। আমার কাছে এ ক্লাব মানেই পৃথিবী। অবশেষে আমি আমার দেশে আমার সংগীত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারব।
ব্রিটিশ পিরিয়ডে এতদাঞ্চলে কলকাতাকেন্দ্রিক সামাজিক ক্লাব গড়ে উঠেছিল। সেখানে ব্রিটিশ সওদাগর ও রাজন্যবর্গরা মনোরঞ্জনের সুযোগ পেত। বড়লোকদের Status symbol হিসেবে সেসব ক্লাব ব্যবহূত হতো। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও মদ্যপান সুবিধা সম্বলিত সেসব ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার সহজ ছিল না। কার্যত ইংরেজরা নেটিভদের থেকে আলাদা দেখাতে সেসব ক্লাব গড়ে তুলেছিল। ঔপনিবেশিক মানসিকতাজাত সেসব ক্লাবের ঐতিহ্য বাংলাদেশ ও ভারতে এখনো আছে সত্য। কিন্তু ইসলাম ধর্মের ফান্ডামেন্টাল স্পিরিটের সঙ্গে কোনোমতেই এ ক্লাব কালচার যায় না। এমনটা সৌদি আরবও ভালো জানে। কিন্তু পরিবর্তিত বৈশ্বিক বাস্তবতায় সৌদির কাছে হয়তো অন্য বিকল্প খোলা নেই। তেল ও স্বর্ণকেন্দ্রিক অর্থ ব্যবস্থাপনার বাইরে এসে পর্যটন নির্ভর ইকোনমি গড়ার দিকে মন দিয়েছেন সেদেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার মুহাম্মদ বিন সালমান।
কিন্তু ধর্মাচার পালনে নিষ্ঠাবান ও ধর্মীয় জ্ঞানে ঐশ্বর্যবান তথা পরহেজগার একজন মুসলিম ক্লাব কালচারে অভ্যস্থ হতে পারবে না। ইসলাম ধর্মে ধর্মীয় বিধিসম্মত অভিভাবক ছাড়া নারীকে ঘরের বাইরে আসাই মানা। যে কারণে নারীদের পুরুষের সঙ্গে সহশিক্ষা কিংবা চাকরী-বাকরীর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। এমন বাস্তবতায় ইসলাম ধর্মের সূতিকাগার সৌদি আরব যেটা করছে, সেটা কি ধর্মীয় বিধিসম্মত? এক কথায় উত্তর হলো অতি অবশ্যই না। মুশকিল হয়েছে অন্য জায়গায়, যারা সৌদি আরব থেকে ধর্মীয় অ্যাক্ট্রিমিজম একসময়ের সহজিয়া বাংলাদেশে এনে চাপিয়ে দিচ্ছেন সেই ওয়াহাবিজমের রক্ষকরা এই সময়ের সৌদি নীতির কোনো সমালোচনা করছেন না। এমনকি বাংলাদেশ সরকারও যদি সৌদির মতো সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করে, পরের দিনই দেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে।
সৌদি আরব দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে লোহিত সাগরের তীরে গড়ে তুলছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ‘নিঅম’ নামে একটি শহর। সৌদি আরব বলছে, ১৬টি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হবে নিঅম, আর ৩৩টি নিউইয়র্কের সমান হবে নতুন এ শহরের আকার। সেখানে থাকবে কৃত্রিম চাঁদ, উড়ন্ত ট্যাক্সির ব্যবস্থা। বাড়িঘর পরিষ্কারের কাজ করবে রোবট। পুরো শহর হবে কার্বনমুক্ত। এবং যথারীতি ওই শহরটিতেও নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণের সুযোগ রাখা হবে। মার্কিন মিয়ামি বিচ কিংবা ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপও নিঅম’র কৃত্রিম বিচের কাছে হার মানবে।
সৌদি আরব ইতোমধ্যে নারীদের ভোটাধিকার, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, পোশাকের বিধিনিষেধ তুলে নেয়া, মাহরাম ছাড়াই হজব্রত পালন, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখা, কনসার্টে যাওয়াসহ নানা অধিকার নিশ্চিত করেছে। সেখানে চালু করা হয়েছে মুভি ও থিয়েটার হল।
সম্প্রতি সৌদি আরবে প্রথমবারের মতো নারীদের সাঁতারের পোশাক পরে ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক দশকেরও কম সময় আগে সৌদি আরবের নারীদের শরীর ঢাকা পোশাক পরতে হতো। সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাওয়া ওই দেশটির সাম্প্রতিক এমন সব হালচাল সবার মাঝেই বিস্ময়বোধের জন্ম দিচ্ছে।
সোজা কথা হলো, জ্বালানী তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সৌদি সমাজ ও অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার জন্য যে ‘ভিশন ২০৩০’ নিয়েছেন দেশটির ভবিষ্যৎ শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ, তারই অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে নিঅম শহর। আত্মীকরণ করা হচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতি।
কিন্তু সৌদির আজকের এ পরিবর্তনটা সরাসরি ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বিরোধী। তারপরও সৌদি নীতির ব্যাপারে বিশ্ব মুসলিম সমাজে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ নেই। ধর্মীয় বিধি অপরিবর্তনীয়। যে কোনো সংস্কারের কথা বলাই পাপাচারতুল্য।
২০২১ সালের এপ্রিলে আল আরাবিয়া টিভিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ধর্মীয় সংস্কারের কথা বলেছিলেন ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান। মডারেট ইসলাম ও মধ্যপন্থী ইসলামের কথা বলে তিনি জানিয়েছিলেন, ওয়াহাবি দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে কোরআন বিশ্লেষণ করতে হবে। তিনি চান না, পাথর মেরে, চাবুক মেরে, মুরতাদ এবং সমকামীদের হত্যা করা হোক। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে আরো বলেছিলেন, কোরআন, সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত সৌদি সংবিধানকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাই।’
কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন সব হাদিস বাদ দেয়ার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মাঝে কেউই চির-অভ্রান্ত দেবতুল্য নই আবার এখানে (ইসলাম চর্চায়) কোনো স্কুল অব থটস বা ধারা নির্দিষ্ট করা নেই। কোরআন হাদিসের বর্ণনা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সমসাময়িকতাকে সব সময় প্রাধান্য দেয়া উচিৎ, ফতোয়া দেয়ার ক্ষেত্রেও স্থান কাল এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর লক্ষ্য রাখা উচিৎ।’ কার্যত ধর্মীয় রিফরমেশন তথা সংস্কারে দৃশ্যমান কোনো অনুসিদ্ধান্তে যাননি সৌদি প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমান। কিন্তু তিনি যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন তা ২০২১ সালের এপ্রিলে দেয়া ওই সাক্ষাতকারকেই যেন পুরোদস্তুর মান্যতা দেয়।
আমাদের কথা হলো প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মবিরোধী সিদ্ধান্তগুলো সৌদি সরকারের তরফ থেকে এলে সেটা নিয়ে বিশ্ব মুসলিম তো বটেই, বাঙালি ধর্মগুরুরাও এতটুকু সমালোচনা করে না। অপরদিকে বাংলাদেশে মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে নারীর মুখ বন্ধ করা নেকাব নিয়ে কেউ সামান্য কথা বললেই সবার অনুভূতি কেমন যেন খসে পড়ে। আমাদের মধ্যে এই দ্বিচারিতা কেন?
আমরা ফিলানথ্রোপিস্টরা নারীর অধিকারের পক্ষে। নারীও পুরুষের মতোই পড়াশোনা, চাকরী-বাকরী সহ সবখানে মানুষের মর্যাদা পাবে এমনটাই চাই। তবে আমরা নাইট ক্লাব কালচারের সমালোচনায় মুখর থাকব। নাইট ক্লাব হলো পুঁজিবাদী ও ধনিক শ্রেণীর পুরুষের আনন্দ-বিনোদন বা মনোরঞ্জনের জায়গা। নারীর সৌন্দর্যে বেপরোয়া পুরুষকে মাতোয়ারা করার জায়গা। অর্থবিত্ত থাকলে মন যা চায় তাই করার জায়গা। যেখানে নারী ও শূরা হলো আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ। মায়ের জাত নারীকে যেখানে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় তা চরমভাবে সভ্যতা বিরোধী। মানুষকে বিস্ট হয়ে ওঠার কোনো কুমন্ত্রণাতেই আমরা নেই।
আমরা চলমান সৌদি সংস্কারকে সাধুবাদ জানাই। তবে তাদেরকে খেয়াল করতে বলি, নারীকে যেন পুরুষের সমান মানুষ মনে করা হয়, ঊন-মানুষ কিছুতেই নয়।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ