লেখাটি শুরু করার আগে নিজের অভিজ্ঞতাটুকু জানিয়ে রাখতে চাই- বছর দুয়েক আগে আমার ছোট ভাইকে পাঠিয়েছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে। প্রথমবার রিক্রুটিং এজেন্সিতে টাকা জমা দেয়ার পর এজেন্সির গাফিলতির কারণে বাতিল হয়েছিল ভিসা। এরপর আগের টাকাগুলো সমন্বয় করে আরো কিছু টাকা বাড়তি দিয়ে ওই এজেন্সির মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের চেষ্টা। এজেন্সির কথা কাজে মিল না থাকা, শর্ত ভঙ্গ, বেশী দাম দিয়ে কালোবাজার থেকে টিকিট কেনা, ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয়ের মতো নানা নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছিল আমাদের। আমি বিশ্বাস করি, এ রকম নানা অভিজ্ঞতা পাড়ি দিয়েই একজন শ্রমিককে স্বপ্নের দেশে যেতে হয় জীবিকার তাগিদে, জীবনের তাগিদে।
এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছিল আমাদের, বাবা বিক্রী করেছিলেন হালের দুটো গরু, ধারদেনা করতে হয়েছিল আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। এভাবেই স্বপ্ন পূরণ করতে দেশের মাটি ছেড়ে একেকজন শ্রমিককে যেতে হয় স্বপ্নের দেশে। কারণ গ্রামে শ্রমজীবী মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকে না।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এবার আসি আসল কথায়। বাংলাদেশীদের জন্য ৩১ মে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। শেষ সময়ে বিমানবন্দরে ভিড় করলেও ফ্লাইট সংকটের কারণে যেতে পারেননি ৩১ হাজার মানুষ। এদের ভিসা ছিল, যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল, টাকাও জমা দিয়েছিলেন এজেন্সিতে; কিন্তু এদের হাতে শেষ বেলায় টিকিট ছিল না, ছিল না বিমানের ফ্লাইট। আবার শেষ সময়ে যারা যেতে পেরেছেন তাদের গুনতে হয়েছে তিন থেকে চারগুণ বাড়তি বিমানভাড়া।
আমার মতো এদের সবার গল্পই এক। কেউ জমিজমা সব বিক্রী করেছেন, কেউ বন্ধক রেখেছেন সোনা দানা, বিক্রী করেছেন গবাদি পশু, কেউ ঋণ করে টাকা জোগাড় করেছিলেন মালয়েশিয়ায় যেতে। অনুমোদন ও ভিসা পাওয়ার পরও ৩১ হাজার বাংলাদেশী কর্মীর সে স্বপ্ন ভেঙেছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, মালয়েশিয়ায় যেতে না পারে এই ৩১ হাজার শ্রমিকের ১৮০০ কোটি টাকা আটকা পড়েছে এজেন্সিতে। এ টাকাগুলো শ্রমিকরা কি ফেরত পাবে? উত্তর আমাদের জানা।
টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি খুব সহজ না। কারণ টাকা ফেরত চাইতে গেলে এজেন্সি জানাবে নানা বাহানার কথা, নানা খরচের কথা, নানা হিসাব-নিকাশের কথা। শেষ পর্যন্ত দেনদরবার করে কোনো কোনো শ্রমিক হয়তো চুইয়ে পড়া পানির মতো পাবেন চুইয়ে পড়া কিছু টাকা। তবে অধিকাংশ শ্রমিক টাকা ফেরত পাবেন না, তারা বঞ্চিত হবেন- এটিই ধ্রুব সত্য। কারণ জমা দেয়া টাকা গেছে স্থানীয় দালালের পকেটে, টাকা খেয়েছে এজেন্সি, টাকা খরচ হয়েছে ভিসা প্রসেসিংয়েও। ভিসা বাবদ মালয়েশিয়া সরকারের কোষাগারে গেছে ৩১ হাজার শ্রমিকের অন্তত ৪০০ কোটি টাকা। এ রকম হিসাব-নিকাশ সামনে আসবে এখন। মালয়েশিয়া সরকারের কোষাগারে জমা হওয়া এ টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে দেখা দেবে অনিশ্চয়তা, যদি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরালো না হয়। সুতরাং ধারদেনা করে স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমানোর আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের সামনে এখন ঘোরতর বিপদ, চোখে তাদের সর্ষে ফুল!
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- শ্রমিকরা যেতে না পারার দায় কার, তদন্ত হবে। দোষীদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে ব্যবস্থা। মালয়েশিয়া যেতে না পারা শ্রমিকদের পাশে আছে সরকার। আমরা এটিও জানি সরকারের পক্ষ থেকে তিন মাস সময় বাড়ানোর জন্য মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হলেও এখনো কুয়ালালামপুরের সাড়া মেলেনি। যদিও প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সময় বাড়াতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। প্রবাসী খাতের বেলায় সরকারের এ আশ্বাসের সঙ্গে কাজের মিল কতটুকু; সেটিও অজানা থাকার কথা। একদিকে সরকার, অন্যদিকে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে শ্রমবাজার। ফলে সরকার আন্তরিকতা নিয়ে এগুতে চাইলেও সিন্ডিকেটের সঙ্গে পারা যেন জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো।
এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা শ্রমিকরা রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। কিন্তু কোনো ধরনের আশ্বাস মিলছে না। সরকার থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া কী হবে সেটিও অজানা। আদৌও টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না কেউ জানে না। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী শ্রমিকদের মনোবেদনা বোঝার চেষ্টা কি আমরা করছি? কেউ কি বুঝতে চাইছেন? শ্রমিকদের কণ্ঠে হতাশার সুর, আত্মহত্যার হুমকি! বোবা কান্না, চাপা কান্নায় আমাদের হূদয় কতটুকু গলবে! শ্রমিকদের সামনে ঘোরতর বিপদ। এ অবস্থায় আমাদের বিপন্ন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর রাষ্ট্রীয় কৌশলটি কী হবে তা নির্ধারণ করা জরুরী। সরকার এসব বিপন্ন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত প্রবাসী আয়। যারা এ প্রবাসী আয়ে অবদান রাখছে তারা কি তাদের প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছে? পরদেশের মাটিতে শ্রমিকরা অপমান-বঞ্চনা মুখ বুজে সহ্য করেন কেবল নিজের ও পরিবারের সুসময় ফেরানোর আশায়। যেমন বাংলাদেশী শ্রমিকদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার ছিল মালয়েশিয়া। দেশটিতে যেতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয় ধরা হয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু উল্টোরথে চলেছে রিক্রুটিং সিন্ডিকেট। বাস্তবে ওই দেশে যেতে লেগেছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। এ বাড়তি টাকা আদায়ের পেছনে কাজ করেছে সিন্ডিকেটের কালো থাবা। গত ১৫ বছরে এ নিয়ে চার দফায় দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হলো। প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের বিষয়টি সামনে এসেছে। আসে সিন্ডিকেটের অনিয়ম, দুর্নীতির কথা। কিন্তু এ সিন্ডিকেট ভাঙা কিংবা চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির তেমন নেই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান, গত ২১ মে পর্যন্ত পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। ২১ মে’র পর আর অনুমোদন দেয়ার কথা না থাকলেও বিএমইটির তথ্য মতে, মন্ত্রণালয় আরো এক হাজার ১১২ কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থাৎ গত ৩০ মে পর্যন্ত পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। আমরা মনে করি, অভিবাসনপ্রত্যাশী বাকি শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় যেতে না পারার সব দায় সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর। তাই যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়া যেতে পারেননি তাদের খরচের টাকা উদ্ধারে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
গত দেড় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী যাওয়া মালয়েশিয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ায় বড় ধাক্কা খেল বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। দুর্নীতি, অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে এ পর্যন্ত চারবার বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালয়েশীয় সরকার। বাংলাদেশী সিন্ডিকেটের কাছে নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও তুলে ধরেছিলেন ঢাকায় মালয়েশীয় হাইকমিশনার হাযনাহ মো. হাশিম। মালয়েশিয়া সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত দেশটিতে বন্ধ থাকবে বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ। তাই শ্রমিকদের সামনে এখন ঘোরতর বিপদ, ঘোরতর সংকট।
আমরা শ্রমিকদের ঘোরতর বিপদ, ঘোরতর সংকট কাটাতে কিছু উদ্যোগ তো নিতেই পারি। আমাদের অর্থনীতিতে বড় অবদান আসে অভিবাসী শ্রমজীবীদের রেমিট্যান্স থেকে। তাই ভবিষ্যতের জন্য যুগোপযোগী পরিকল্পনা করতে হবে। বিদেশে নতুন ধরনের কর্মক্ষেত্র তৈরীতে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোরারোপ করতে হবে। বিদেশে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত পাচারকারী দমন, বিদেশের নিয়োগকর্তাদের মানবিক ভূমিকা নিশ্চিতকরণ, কাজের ও থাকার পরিবেশের উন্নয়ন, শ্রমজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশে উচ্চহারে মৃত্যুর খবর বা উপার্জনের জন্য বিদেশে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরার অভিজ্ঞতা দেশ আর চায় না। মোট কথা আমাদের শ্রমজীবীরা যেন একতরফা বিভিন্ন মহলের দ্বারা শোষণের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা জরুরী। আশা করি, সরকার বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের সুরক্ষার দিকেও নজর দেবে। আরো কিছু কাজ করতে হবে। বিদেশ গমন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। অভিবাসন ব্যয় কমাতে হবে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকের তিন-চার বছর সময় চলে বিদেশ যাওয়ার সময়ে করা ঋণ শোধ করতে। অনেকে আবার না বুঝে দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারান। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এ সব প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সব প্রবাসী শ্রমিকদের ‘জীবন বিমার’ আওতায় আনতে হবে। বিদেশে কোনো সমস্যায় পড়লে সে সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানাতে হবে। একটা নিরাপদ জীবন, নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কি আমরা করতে পারব না? তা না হলে হতভাগ্য মানুষরা কোথায় যাবে?
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ