আগামী বৃহস্পতিবার ৬ জুন জাতীয় সংসদের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। যা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট।
স্বাভাবিকভাবেই নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়েও আসন্ন বাজেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের থেকে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিমত উঠে আসছে। বলা হচ্ছে, গত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে অন্তত ছয় বছরের বাজেটের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাঁরা সবাই সরকার ও ক্ষমতাসীনদের অনুসারী বলেও অভিযোগ।
রাজনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ নির্ভর হয়ে দেশের অর্থনীতি পুরো ফোকলা হয়ে গেছে। যেসব নিম্নবিত্ত রয়েছে যাদের বেতন মাসে ১০ হাজার টাকা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদেরও মাসের শেষে কোনো না কোনোভাবে ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তার একমাত্র কারণ সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও শত শত দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পাচারকারী চিহ্নিত হলেও গত ১৫ বছরে তাদের বিচার করা হয়নি। অর্থ পাচার করে দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় নিরাপদে পালিয়ে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, গত ১৫ বছরে জনগণের লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই টাকাগুলো উদ্ধার করতে পারলে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয়টি বছরের বাজেট অনায়াসে করা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যারা ১৫ বছরে টাকা পাচার করেছে তারা সবাই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় করেছে। এ পাচারকারীরা যখন চিহ্নিত হয় তখন আবার সরকারের সহযোগিতা তারা পালিয়েও যায়। দুর্নীতির সম্রাট বেনজীরের ক্ষেত্রে তাই দেখা গেছে। আরেক সম্রাট আজিজও একই পথে। আসলে এ সরকারের পক্ষে দুর্নীতিবাজদের ধরা সম্ভব নয়। কারণ এ দুর্নীতিবাজদের কারণে এ সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। তিনি আরও বলেন, আজকে বলতে বাধা নেই এই দেশ মানুষের বসবাসের দেশ না! ডিমের দাম পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। গরীব মানুষ আর সবজীও কিনে খেতে পারছে না। যার বেতন মাসে ১০ হাজার টাকা, বেঁচে থাকার তাগিদে ওই মানুষকেও মাসের শেষে ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এগুলোর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যেত যদি দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
ঋণ খেলাপীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যেত। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যেত। এ সরকার এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। তবে আল্লাহ ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না। তার প্রকৃত উদাহরণ হয়ে থাকবে এমপি আনার। ১৫ বছরের ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অতীতে যত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তা কখনোই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ঘাটতি থাকে প্রচুর। যেসব ডেভেলপমেন্টের পরিকল্পনা নেয়া হয় তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পারে না। এতে করে ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পায় তাতে আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘনিষ্ঠজনদের সুবিধা হয়। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য যেই ধরনের বাজেট দরকার তা তারা (সরকার) কখনোই গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারে না। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ক্ষমতাসীন সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে ফেলেছে।
পত্র-পত্রিকার খবরগুলো বলছে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা পাচার হচ্ছে আর সেগুলো অবশ্যই ডলারের মাধ্যমেই হচ্ছে। পাচারের অর্থগুলো যোগ করলে অবশ্যই কয়েকটি বাজেট করা যেতে পারে এমন সংখ্যা দাঁড়াবে। পৃথিবীর সব দেশে প্রত্যেক বছর বাজেটের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করে তেমনি এ সরকারও সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এবার সম্ভবত সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার ওপর করা হচ্ছে। এখন যাদের বেতন ১০-১২ হাজার টাকা কিংবা গরীবদের জন্য কি থাকছে সেটা বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করি তখন মন্তব্য করব। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে বাজেট ঘোষণা করা হয়, যাতে করে সেই বাজেট থেকে তারা উপকৃত হয়।
কিন্তু গত ১৫ বছরে আমরা তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাইনি। বাজেট থেকে শুধু সরকার এবং তার সুবিধাভোগীরা উপকৃত হয়। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে বেগম পাড়া তৈরী করে। এবার যেই বাজেট ঘোষণা করা হবে তা থেকেও সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হবে বলে মনে হয় না। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আসাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা নৈরাজ্য চলছে। টাকা পাচার না কমিয়ে এই বাজেট আরও দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি করে ঘোষণা করলেও ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না। প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী হবে।
এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, সরকার যেভাবে ঋণনির্ভর হচ্ছে এতে করে বাজেট ঘোষণার পর প্রতিটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী হবে। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে বাজেট ঘোষণা করা উচিত। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, বাজেট ঘোষণার আগেই ব্যাংক শূন্য, মানুষের হাতে টাকা নেই, সরকারের হাতে টাকা নেই। এর আগে যেই বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তা কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। মুদ্রাস্ফীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাজেট ঘোষণার পর প্রতিটি পণ্যের দার বৃদ্ধি পাবে এতে করে সাধারণ মানুষ চরম অবস্থার মধ্যে চলে যাবে। যেই বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করার সুযোগ নেই। কারণ কেবল দেশী-বিদেশী ঋণের নির্ভর হয়ে বাজেটে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে এ দুঃসময়ে দরিদ্র মানুষের জীবন ও জীবিকার সমাধান আগামী বাজেটে হবে— এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ছাড়া দেশের সচেতন মহল থেকে দাবী উঠেছে, দারিদ্র্য, নদী ভাঙন ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবং কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকায় ভিড় করছেন।
মেগাসিটি ঢাকায় ৩০ হাজারের বেশী বস্তিতে প্রায় ৩৫ লাখ লোক বাস করে এবং যার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারে না। দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। আরো রয়েছে লাখ লাখ পথশিশু। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যার ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাই এবারের বাজেটে বেকারত্ব দূরীকরণ, নদী ভাঙন রোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং শিশুদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ