দুধ হচ্ছে একটি সুষম খাদ্য। দেহের মধ্যে জৈবিক ক্রিয়া, বৃদ্ধি ও শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপাদান দুধে বিদ্যমান রয়েছে। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার প্রোটিনের একটি ভালো উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম দুধে গড়ে ৩.৪ গ্রাম প্রোটিন থাকে। এ ছাড়াও প্রতি ১০০ গ্রাম দুধে ৪২ ক্যালরি শক্তি, শর্করা ১ গ্রাম, ফ্যাট ১ গ্রাম, কোলেস্টেরল ৫ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১২৫ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৪৪ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৯৫ মিলিগ্রাম রয়েছে।
স্বল্প ফ্যাটযুক্ত এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় দুগ্ধজাত পণ্যগুলো সাধারণত রক্তচাপ কমায় এবং দিনে ২০০-৩০০ মিলি দুধ গ্রহণে হূদরোগের ঝুঁকি কমায় বলে সম্প্রতি গবেষণায় পাওয়া গেছে।
ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ভিটামিন ডি এবং প্রোটিন মানব দেহের জন্য মূল পুষ্টি উপাদান, যা পেশী ও হাড়ের গঠন ও গুণমানকে প্রভাবিত করে। বর্তমান তরুণ সমাজ কোমল পানীয় ছাড়া তাদের দৈনন্দিন জীবন কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু কোমল পানীয় স্বাস্থ্যসম্মত নয় বরং এতে থাকা অতিরিক্ত চিনি দেহে বিষের মতো ক্ষতিসাধন করে। তাই এসব কোমল পানীয় পরিহার করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণ সুস্থ সবল জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে।
বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ জুন দিবসটি পালিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরও সারা দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। এ বছরের দুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘বৈশ্বিক পুষ্টিতে দুধ অপরিহার্য’।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে দুধের উৎপাদন ছিল ৯৯ দশমিক ২৩ লাখ টন যা পাঁচ বছরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুধের চাহিদা ছিল ১৫৮ দশমিক ৫ লাখ টন (জনপ্রতি চাহিদা ২৫০ মিলি ধরে), যার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১৪০ দশমিক ৬৮ লাখ টন। ফলে জনপ্রতি দুধের প্রাপ্যতা দাঁড়িয়েছে ২২১ দশমিক ৮৯ মিলি। সুতরাং বলা যায়, দেশ আজ দুগ্ধ উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মানব জাতির দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খামার থেকে টেবিল পর্যন্ত টেকসহ পুষ্টির জন্য দুধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার খাদ্য তালিকা নির্দেশিকা অনুসারে নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়ার সুপারিশ করা হয়। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার শিশুদের মস্তিষ্ক গঠনে সহায়তা করে। দুগ্ধজাত খাবার, যেমন পনির ও দই আদর্শগতভাবে স্বাস্থ্যকর অ্যাজিং প্রোডাক্ট হিসেবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (২০১৫) নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যকর অ্যাজিং হলো কার্যকর ক্ষমতার বিকাশ এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার প্রক্রিয়া, যা বার্ধক্যে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। দুগ্ধজাত দ্রব্য বয়স্কদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে, পেশীর স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং বার্ধক্যজনিত পেশী ও হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে। তাই দুগ্ধজাত দ্রব্য বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, এ ধরনের পুষ্টিসমৃদ্ধ দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ বিপাকীয় রোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রকোপ কমায় এবং কিডনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় (ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চ ২০১৬) পাওয়া যায় যে, একটি স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় দুগ্ধজাত দ্রব্য যোগ করা হলে এর গুণগতমান বৃদ্ধি পায়, যা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর পেশীশক্তি হ্রাস রোধে সহায়তা করে। এ ছাড়াও
দুগ্ধ প্রোটিন, যেমন কেসিন ক্ষুদ্রান্ত্রে ক্যালসিয়াম ও ফসফেট শোষণকে সহজ করে এবং এটি বায়ো-অ্যাকটিভ পেপটাইড উৎপাদনের প্রধান উপাদান। এই বায়ো-অ্যাকটিভ অণুগুলোর মধ্যে কয়েকটি ল্যাকটোট্রাইপেপটাইড পাওয়া যায়, যা অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইমকে (এসিই) বাধা দিয়ে রক্তচাপ কমায় বা নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম (এসিই) একটি ভ্যাসোকন্সট্রিক্টও (রক্তনালী সংকোচনকারী) এবং এটি অ্যালডোস্টেরন নিঃসরণকে উদ্দীপ্ত করে, যা কিডনী দ্বারা সোডিয়াম এবং পানি ধারণ করে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করে রক্তচাপ কমায় বা নিয়ন্ত্রণ করে।
পরিশেষে, দেশে দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে আরো গবেষণার প্রয়োজন। বিশেষ করে আরো বেশী পুষ্টিকর দুগ্ধজাত খাবার সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যা ভোক্তার সুস্থ জীবন যাপনে সহায়তা করবে। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ করে দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মেধাবী জাতি গঠন করা ও বার্ধক্যের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ