টক শো আমি দেখি না। যখন টিভি চ্যানেলগুলোতে এর যাত্রা শুরু হয় তখন কিছুদিন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। মনে হতো, আরে! এরা তো আমাদের কথাই বলে। যে কথাগুলো আমরা সাধারণ মানুষরা কোথাও গিয়ে বলতে পারি না। সেগুলোই তারা অনায়াসে তথ্যসমেত জাতির সামনে তুলে ধরে। কী ভীষণ ধারালো এক একজনের যুক্তি এবং উপস্থাপন শৈলী! কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নয় যেন।
লড়ে যাচ্ছে সমানে সমান। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরই লক্ষ করলাম, কেমন যেন একঘেয়ে লাগছে। আগের মতো সেই ভালোলাগাটা নেই। শোগুলোতে সব সময় দু’টি পক্ষই থাকে। একপক্ষ সরকারের সপক্ষে গীত গাইবেই। আরেক পক্ষ হোক বা না হোক, তাতে সত্য থাকুক বা না থাকুক সরকারের বিরুদ্ধে বলবেই। সরকারের পক্ষে যারা বলে তারা যেমন অধিকাংশ সময় সত্য লুকিয়ে নানা কাহিনীর অবতারণা করে তেমনি সরকারবিরোধীরাও সরকারের সব সাফল্য পাশ কাটিয়ে শুধু ব্যর্থতাগুলোই আওড়াতে থাকে।
আরেকটি পক্ষ তৃতীয় পক্ষ হয়ে আসে। তারা সরকার এবং সরকারবিরোধীদের দ্বিমুখী চাপে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে না করতেই অগোছালো হয়ে যায়! এসব দেখে দেখে এক সময় মনে হলো, আরে ধুর! এরা যা বলছে তা তো সারাক্ষণ নিউজে শুনি, আলোচনায় শুনি, মানুষের ক্ষোভ, হতাশা, আশার দোলাচলেও শুনি- তাই এসব বাদ। একদম সব বাদ। কানে মুখে তুলো গুঁজে বরং নিজের কাজ করি। কিন্তু কতক্ষণ, কতদিন এভাবে থাকা যায়? বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্বিকার থাকা যায়? বিবেকের তাড়নায় তাই কলম ধরতেই হয়।
আবার কেউ কেউ বলল, না। এর পেছনে ইসরায়েল রয়েছে। তাদের ওপর হামলা চালানোর প্রতিশোধ নিয়েছে এভাবে! তারা বুঝতে পেরেছিল, রাইসি বেঁচে থাকলে আরো হামলা হবে। আমেরিকা যতই পাশে থাকুক, তাদের একচ্ছত্র জঙ্গিপনা বেশী দিন টিকবে না। তাই সুযোগ পেয়েই কাজ সেরে ফেলেছে। আরে বাবা! এদের কে বোঝাবে, ইসরায়েল কী আমেরিকার পরামর্শ, সমর্থন, সহায়তা ছাড়া এক পা নড়ে? কথা তো যেই লাউ, সেই কদুই। যাহা ইসরায়েল, তাহাই তো আমেরিকা! এটা না বোঝার কী আছে?
তো যাই হোক। একটি প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্ট বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন- এটি হেলা করার বিষয় নয়। কিন্তু তার দেশের জনগণের একাংশ এতে খুশী হয়েছেন, মিষ্টি বিলিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকেই মাতম করেছেন। জানাজায় লাখো মানুষের ঢল প্রমাণ করে তিনি একজন ভালো নেতা ছিলেন। কিন্তু এ কথাও অনেকে বলছেন, তার হাত অনেকের রক্তে রঞ্জিত। হিজাব এবং সতীত্ব আইন ইস্যুতেই তিনি ৫০০০ মানুষকে হত্যা করেছেন। গ্রেপ্তার করেছেন ২২ হাজার মানুষকে। নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছেন তাদের ওপর।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তিনি ইরানের নারীদের হিজাব ব্যবহারে কিছু শিথিলতা এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন। কিন্তু যিনি ইসলাম ধর্মের একজন খাঁটি অনুসারী, ধর্মের কঠিন সত্যকে সুউচ্চতায় ধরে রাখতে তিনি কী কোনো পরিস্থিতিতেই নিজ অবস্থান থেকে সরে আসেন? তাহলে রাইসি কেন সরে আসলেন? এটি কী প্রমাণ করে না, নারীদের হিজাব ব্যবহারে তার কঠোরতা সঠিক ছিল না? ইসলাম ধর্মের প্রকৃত অনুসারী ইসলামের আদর্শ রক্ষার প্রশ্নে কখনোই আপস করে না। কিন্তু নিজ নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ার পর আগের অবস্থান থেকে সরে এলে সে না একজন খাঁটি মুসলমান, না ভালো শাসক। তাহলে রাইসি কী সেই কাজটিই করলেন গতানুগতিক ধর্ম ব্যবসায়ীর মতো, যারা নিজের নিরাপত্তার খাতিরে ভোল পাল্টে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাবে না?
রাইসির মৃত্যু নিয়ে ঘোর কাটতে না কাটতেই ঝিনাইদহ-৮ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার প্রথমে নিখোঁজ হলেন, পরবর্তীতে জানা গেল তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কার মৃত্যু কীভাবে আসবে কেউ জানে না। তবে আনারকে হত্যা করার পর তার দেহকে যেভাবে টুকরা টুকরা করা হয়েছে বলা হচ্ছে এবং নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য যেভাবে টুকরাগুলোর গায়ে হলুদ মাখানোর বর্ণনা এসেছে তাতে স্তম্ভিত না হয়ে উপায় নেই। আমরা তখনো জানতাম না, এখনো জানি না আসলে তার পরিণতি ঠিক কী হয়েছে? দু’সপ্তাহের বেশী সময় পার হয়ে গেছে, এখনো তার মরদেহের হদিস মেলেনি।
গ্রেপ্তার আসামীদের জবানবন্দী অনুযায়ী তল্লাশি চালানো হচ্ছে। কোথাও মিলছে না আনারের হদিস। সর্বশেষ যে ভবনটিতে তিনি অবস্থান করছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে সেই ভবনের সেপটিক ট্যাংকে কিছু মাংসপিণ্ড এবং হাড়ের খণ্ড বিশেষ পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো আদৌ আজীম আনারের কিনা তা ডিএনএ টেস্ট ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ভাষা হারিয়েছি। আরো বেশী বিষণ্ন এবং বিধ্বস্ত হয়েছি যখন শুনেছি এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িত তারই বাল্যবন্ধু। আহা! বন্ধু শব্দটির ওপর এমন নির্মম আঘাত না করলেই কি হতো না? আমরা তবে কার কাছে যাব? কার কাছে গচ্ছিত রাখব আমাদের সরল বিশ্বাস? আমাদের অন্তরের একান্ত ব্যথা বা ঘোরতর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস আর গুমোট কান্নাগুলোই বা কার কাছে গিয়ে জমা রাখব? বাল্যবন্ধু- এর চেয়ে উচ্চতর সম্পর্ক আর কী থাকতে পারে? সেটাও তবে এভাবে চুরমার হয়ে গেল?
আজীম আনারের মৃত্যুর পরও রাইছির মতোই অনেকে বলছেন, তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন। তিনি এলাকাবাসীকে উদারহস্তে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে তার নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষের আহাজারি সেটাই প্রমাণ করে। আবার গণমাধ্যমে অপরাধী হিসেবে তার যে ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমরা কাকে বিশ্বাস করব? সাধারণ মানুষের আহাজারি নাকি মিডিয়ার খবর নাকি বাবাহারা মেয়েটির করুণ আর্তনাদ? আনারের কন্যাটি বলছে, প্রধানমন্ত্রী তার বাবাকে হারিয়েছেন। তাই তিনি আমার ব্যথা বুঝবেন। বুঝবেন ঠিক আছে। কিন্তু কন্যাটিকেও বুঝতে হবে প্রধানমন্ত্রীর বাবা হারানো আর বাবা হারানোর প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে প্রধানমন্ত্রীকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং করার সুযোগ নেই। দুটো ঘটনা এক কাতারে দাঁড় করানো যাবে না। তবে পুরো বিষয়টির স্পষ্ট সুরাহা হোক।
আমরা সাধারণ মানুষ চারপাশের এত চাপ নেয়ার সক্ষমতা কি রাখি? এমনিতেই তো আমাদের নিজেদের দীর্ঘশ্বাসের শেষ নেই। আমরা বাজারে গেলে হাঁপিয়ে উঠি। নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্য আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা আমাদের প্রয়োজনকে কাটছাঁট করতে করতে ভেবে পাচ্ছি না এরপর কোন পথে প্রয়োজনকে শাসাব। শহরজুড়ে, না না দেশজুড়ে ইমারতের পর ইমারত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। অলিতে গলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, অনলাইনে কত সেবা প্রতিষ্ঠান- অথচ আমরা প্রতারিত হচ্ছি সর্বত্র, নিঃস্ব হচ্ছি বারবার! এর ওপর আর কত চাপ নেয়া যায়!
সেদিন এক বন্ধু গল্প করছিল। বলছিল- বিদেশী কিছু শিক্ষার্থী এসেছিল বাংলাদেশে পড়াশোনা করতে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের সহপাঠীরা জানতে চেয়েছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন কী? তারা তিনটে বিষয় তুলে ধরেছিল, ১. তোমরা কোনো কিছু ভালো হতে দেখলেই খুশী হয়ে বলো, ওহ দারুণ। তার চেয়ে আরেকটু ভালো কিছু হতে দেখলে বলো, ওয়াও দারুণ। আরো যদি ভালো কিছু হতে দেখো তখন মুগ্ধতায় বিহ্বল হয়ে সেটা প্রকাশ করার ভাষাই হারিয়ে ফেলো। ২. তোমরা খুব নৃশংস বা নিষ্ঠুর একটি জাতি। ইংরেজিতে যাকে বলে, ব্রুটাল।
এবার বাংলাদেশের সহপাঠীরা চেপে ধরল। এর আগে যা বলেছ, তা মেনে নিলাম। কিন্তু কেন নৃশংস বললে আমাদের? কেন নিষ্ঠুর জাতি বললে ব্যাখ্যা দাও। তখন তারা বলল- তোমরা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করো। খুন করেও ক্ষান্ত হও না। মরদেহকে টুকরা টুকরা করে বস্তায় ভরে খালে বিলে নর্দমায় ফেলে দাও। কোনো সভ্য জাতি এটা পারে না। আমাদের দেশেও খুন হয়। তবে তা এত নৃশংস নয়। জাস্ট একটি বুলেট খরচ করি মাত্র।
তৃতীয় মূল্যায়নটি আমার বন্ধু মনে করতে পারেনি। তাই আমিও কিছু জানতে পারিনি। এখানেও কিছু জানাতে পারিনি। তবে বন্ধুটি যখন গল্পটি করছিল তখন কেন আমরা নিষ্ঠুর জাতি এর ব্যাখ্যায় আমি উদগ্রীব হয়ে শুনতে চেয়েছিলাম তারা বলবে- তোমরা তোমাদের জাতির পিতাকে পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছ। ১০ বছরের একটি শিশুও তোমাদের নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা পায়নি। আইন করে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার রোধ করেছ। তোমরা এরপরও ব্যাখ্যা চাইছ কেন তোমরা নিষ্ঠুর জাতি?
কিন্তু তারা এ কথাগুলো বলেনি। বলেনি, কারণ তাদের জানতেই দেয়া হয়নি ১৯৭৫-এর নির্মমতার কথা। বলা হয়নি ১৯৭১-এ এই দেশের মানুষের সঙ্গে কী ভয়াবহ নির্মমতা, নৃশংসতা হয়েছে। হয়তো তারা এর আগে ব্রিটিশরা কীভাবে আমাদের শোষণ করেছে তাও জানে না। তারা জানে না, আমরা নীলকুঠী জাতি। আমাদের রক্তে আবহমান কাল ধরে নৃশংসতার রক্ত বহমান। আমরা নৃশংসতার শিকার হতে হতে নিজেরাই এখন নৃশংস হয়ে উঠেছি।
আমরা সব সময় এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে থাকি। অনেক কিছু বুঝেও বুঝি না। আবার কাউকে বোঝাতেও পারি না। আমরা সাধারণ মানুষ অন্যের মুখে বারবার ঝাল খাই আর অসহায়ভাবে বিভ্রান্ত হতে থাকি।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ